প্রসূতি মায়ের যত্ন,এন্টিনেটাল কেয়ার!
- রেজবুল ইসলাম
- ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৮
গর্ভধারণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পিত সেবাদান জরুরি।এতে শিশুর জন্মদান সুন্দরভাবে করা যায়। গর্ভকালীন সাক্ষাত বলতে বোঝায় গর্ভকালীন সময়ে গর্ভবর্তী ও চিকিৎসকের সংস্পর্শ। স্বাভাবিক গর্ভধারনের ক্ষেত্রে একজন গর্ভবর্তী তার প্রতি মাসে একবার এভাবে প্রথম ৭ মাস, মাসে দুবার এভাবে পরবর্তী মাস, প্রতি সপ্তাহে এভাবে অবশিষ্ট হিসেবে এন্টেনেটাল ক্লিনিক (যেখানে এ সেবা প্রদান করা হয়) যাবেন-
এন্টিনেটাল কেয়ার বা প্রসূতি মায়ের যত্ন বলতে আমরা কী বুঝি?
যেকোনো মেয়ে যখন প্রথম গর্ভবতী হলো তখন থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত একটি পরিকল্পিত সেবা দানকে আমরা বলি প্রসূতি মায়ের যত্ন বা এন্টিনেটাল চেকআপ। এ বিষয়টির আওতায় কোন কোন বিষয়গুলো পড়ে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই সেবাগুলো আসলে কীভাবে আসছে গর্ভবতী মায়ের ক্ষেত্রে?একটি মেয়ে যখন গর্ভবতী হলেন তাঁর জীবনে একটি নতুন পরিক্রমা শুরু হলো। এই চলার পথে তার অনেক বাধা বিপত্তি আসতেও পারে। সেই বাধাগুলো অতিক্রম করে সুন্দরভাবে সন্তান জন্ম দেওয়া হচ্ছে তার জীবনের একটা সাফল্য। সুতরাং এই চলার পথে তাকে কিছুটা নির্দেশনা দিতে হয়, উপদেশ দিতে হয়। কিছুটা উন্নত মানের চিকিৎসা দেওয়া দরকার।
ওয়ার্ল্ড হেলথ ওরগানাইজেশন বলেছে, গর্ভাবস্থায় একজন মা অন্তত চারবার চিকিৎসকের কাছে যাবে, এন্টিনেটাল চেকআপ নেবে। এখন কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, হাসপাতাল রয়েছে- এসব জায়গায় যাবে। প্রথম ১৬ সপ্তাহে একবার এলো, পরে ২৮ সপ্তাহে এলো, তারপর ৩২ সপ্তাহে এলো, এরপর একেবারে শেষে একবার এলো। অন্তত এই চারবার যদি একজন মা চিকিৎসকের কাছে এসে থাকেন তাহলে তার এই পথটি খুব সুগম হয়। গর্ভকালীন তার কোনো সমস্যা হলে সেগুলো সমাধান করা সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে আমরা মূলত তাকে বলি, কী খেতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, কোনো ওষুধের দরকার আছে কি না, যেই সন্তানটি তার আসছে সে ভেতরে সুন্দরভাবে বড় হচ্ছে কি না- এজন্য চেকআপ করতে হবে এবং কিছু পরীক্ষা করতে হয়।
প্রথম গর্ভকালীন সাক্ষাতের কার্যবিধি:
ক) গর্ভবর্তী মহিলার নিবন্ধন
খ) ইতিহাস গ্রহণ
গ) পরীক্ষা নিরীক্ষা
ঘ) প্রয়েজনীয় ইনভেস্টিগেশন বা অনুসন্ধান
ঙ) পরামর্শ
গর্ভবর্তীর নিবন্ধন: পরবর্তিতে তথ্য হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গর্ভবর্তীকে নিবন্ধন নিবন্ধিত করতে হবে।
ইতিহাস গ্রহণ: বর্তমান গর্ভাবস্থার ইতিহাস:
১) সর্বশেষ মাসিকের প্রথম দিন (এল এম পি)
২) কোন ব্যথা বা রক্তক্ষরন
৩) মাসিক নিয়মিত বআ অনিয়মিত
৪) জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি সেবন করে কিনা ইত্যাদি
পূর্ববর্তী গর্ভাস্থার বিবরন (গর্ভধানের ক্ষেত্রে):
১) পূর্ববর্তী গর্ভধারন ও প্রসব
২) গর্ভপাত
৩) অকাল প্রসব
৪) গর্ভে শিশুর মৃত্যু
৫) একাম্পশিয়া
৬) যন্ত্রের সাহায্যে প্রসব (ফরসেপ ডেলিভারি) ইত্যাদি
সাধারন ইতিহাস:
১) হৃদরোগ ও উচ্চরক্তচাপ
২) শ্বাসতন্ত্রের রোগ যেমন-এজমা
৩) পূর্ববর্তী স্ত্রী রোগ জনিতহ বা অন্যান্য অস্ত্রপ্রচার ইত্যাদি
পরীক্ষা নিরীক্ষা:
সাধারন পরীক্ষা নিরীক্ষা:
১) উচ্চতা
২) ওজন
৩) এনিমিয়া
৪) জন্ডিস
৫) ইডেমা বা শোথ স্ত্রী রোগ বিষয়ক পরীক্ষা নিরীক্ষা
৬) স্তন ও এর বৃন্ত পরীক্ষা
৭) উদরের পরীক্ষানিরক্ষা
৮) জরায়ুর আকার ও আকৃতি
৯) জরায়ুর অবস্থান
১০) ভ্রুনের আকার
১১) ভ্রুনের উপস্থাপনা ও আচরন
১২) ভ্রুনের হ্রদ কম্পন শ্রবণ
১৩) অন্যান্য অস্বাভাবিকতা
জননপথের পরীক্ষা নিরীক্ষা: যেমন- ১০ পি/ডি পরীক্ষা ২) বাহ্যিক জনন অঙ্গের পরীক্ষা নিরীক্ষা ইত্যাদি
অত্যাবশ্যকীয় অনুসন্ধান: যেমন-
১) রক্ত: এ বি ও গ্রুপিং আর এইচ ফ্যাক্টর, হিমোগ্লোবিন নির্ণয়
২) মুত্র: আর এম ই, গর্ভধারন পরীক্ষা
৩) মল পরীক্ষা: আর এম ই
৪) হেপাটাইটিস বি, যৌন রোগ ও এইডস এর পরীক্ষা
৫) আল্ট্রাসনোগ্রাফি
ঙ. উপদেশ: গর্ভকালীন উপদেশ সমূহ: পরবর্তী গর্ভকালীন সাক্ষাতের কার্যবিধি:
১) গর্ভ সংক্রান্ত সমস্যা সমুহের ব্যপারে ইতিহাস গ্রহণ
২) পূর্ববর্তী প্রাপ্তির ওপর ভিত্তি করে পরীক্ষা নিরক্ষী
৩) অনুসন্ধান:
(ক) রক্তের হিমোগ্লেবিন পরিমাপ এবং অন্যান্য যা প্রয়োজন
(খ) আল্ট্রাসনোগ্রাফি গর্ভকালীন কিছ বৈকল্য চিহ্নিত করার জন্য যেমন প্লাসেন্টা প্রিভিয়া
৪) বিশেষ রোগ তেহকে রক্ষা (সাধারন ভাবে এনিমিয়ার জন্য)
৫) উপদেশ।
গর্ভকালীন উপদেশ :
১. খাদ্য: পরিমানে অল্প করে বার বার খেতে হবে। এক বেলা বেশি খাবার খেতে হবে। দুই খাদ্যের মধ্যবর্তী সময়ে প্রচুর পানি পান করতে হবে। পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য খেতে হবে।
২. ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি: ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, বিশ্রাম ও ঘুম, দাঁতের যত্ন ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। কোষ্ঠবদ্ধতা, শারীরিক পরিশ্রম, ধমপান, মদ্যপান, সহবাস (বিশেষত শেষ তিনমাস) পরিহার করে চলতে হবে।
৩. ঔষধ: রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিত কোন ঔষধ সেবন করা যাবেনা।
৪. মানসিক চাপ পরিহার করতে হবে।
৫. বিকিরন: বিশেষত প্রথম থেকে চতুর্থ মাস পর্যন্ত উদরের এক্স-রে পরিহার করতে হবে। তবে সব ক্ষেত্রেই তা রেজিষ্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে হতে হবে।
বিপদজনক চিহ্ন সম্পর্কে জ্ঞান: নিচের চিহ্নগুলোর যে একটি দেখা দিলেই গর্ভবর্তীকে দ্রুত যোগাযোগ করার কথা বলতে হবে-
গর্ভকালীন সময়:
১) পা ফুলে যাওয়া বা পায়ে পানি আসা।
২) মাথা ব্যথা, চোখ ঝাপসা দেখা।
৩) খিঁচুনি।
৪) জরায়ুথেকে রক্তক্ষরন বা কোন পদার্থ নিঃসরন।
প্রসব কালীন:
১) দীর্ঘস্থায়ী প্রসব বেদনাম
২) অস্বাভাবিক উপস্থাপনাম
৩) খিঁচুনি
৪) রিটেইন্ড প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল ভেতরে থেকে যাওয়া
৫) অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরন।
৬) প্রচন্ড জ্বর ও জরায়ু থেকে দুর্গন্ধ যুক্ত স্রাব হওয়া।
৭) খিঁচুনি।
৮. জরুরী ব্যবস্থাপনা: কোন জরুরী অবস্থার উদ্ভব হলে তার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারনা দিতে হবে। যেমন- অর্থ সঞ্চয়, যানবাহনের ব্যবস্থা, রক্ত দাতার ব্যবস্থা ইত্যাদি।
৯) প্রেরন কেন্দ্র সম্পর্কে পরামর্শ। (জরুরী অবস্থায় যোগাযোগের স্থান)।
১০) শিশু যত্ন: শিশুর যত্নের কলা কৌশল সম্পর্কে অবহিত করতে হবে
বিশেষ রোগ থেকে রক্ষা : গর্ভবর্তী মা নিম্নলিখিত রোগ থেকে রক্ষা করতে হবে-
ক) এনিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতা: আয়রন ও ফলিক এসিড সরবরাহের মাধ্যমে সহযেই প্রতিরোধ করা যায়;
খ) অন্যান্য পুষ্টি অভাব জনিত সমস্যা;
গ) গর্ভকালীন বিষক্রিয়া (টক্সিমিয়া অব প্রেগনেন্সি);
ঘ) টিটেনাস (টিকা দানের মাধ্যমে);
ঙ) সিফিলিস;
চ) জার্মান মিসেল্স;
ছ) আর এইচ (রেসাস) জটিলতা;
জ) এইচ আই ভি।
মানসিক প্রস্তুতি: মানসিক প্রস্তুতি শারীরিক প্রস্তুতির মতই গুরুত্বপুর্ণ। এসময় তার সঙ্গে খোলা মেলা ভাবে গর্ভধারন ও প্রসব সম্পর্কিত বিষয় গুলো সম্পর্কে কথা বলতে হবে। গর্ভবর্তীর মন থেকে ভয়, উদ্বিগ্নতা দূর করতে হবে। গর্ভকালীন সময় মানসিক প্রফুল্লতা বজায় রাখার ব্যপারে পরামর্শ দিতে হবে।
পরিবার পরিকল্পনা : ইহা প্রতিটি মৃতৃত্ত্ব চক্রের সাথে সম্পর্কিত । এ সময়ে মহিলারা উপদেশ গ্রহণের জন্য মানসিক ভাবে উপযুক্ত থাকে তাই এসময় তাকে পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানাতে হবে। পর্যাপ্ত উপদেম ও জ্ঞান দানের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রন ব্যবহারে উদ্বৃদ্ধ করতে হবে।
তথ্য এবং ছবি : গুগল