গলা-বুক জ্বালাপোড়া করে কেন? সমাধান কী
- ওমেন্স কর্নার
- মার্চ ৩১, ২০২৪
গলা-বুক জ্বালাপোড়া করার সমস্যা অনেকেরই দেখা দেয়। মুখে টক বা চুকা ঢেঁকুর ওঠে, হজমের সমস্যা হয়। হঠাৎ রিচ খাবার বেশি খেলে এমন হয়। এক্ষেত্রে পেটের ভেতর চরম মাত্রায় অস্বস্থি কাজ করে।
অনেকে এটা সাধারণ গ্যাসের সমস্যা বলে মনে করেন। আসলে এটি কোনো বংশগত রোগ নয়। পুরুষদের তুলনামূলক বেশি হতে দেখা যায় এই সমস্যা।
গলা-বুক জ্বালাপোড়া করার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক এবং পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ।
মুখ থেকে পাকস্থলীতে সংযোগ রক্ষা করে যে নালি তাকে খাদ্যনালি বা ইসোফেগাস বলে। খাদ্যনালির শেষ প্রান্তে ও পাকস্থলীর শুরুতে পেশিবহুল একটি ভাল্ব বা কপাটিকা থাকে। এ কপাটিকার কাজ হচ্ছে খাদ্যনালি থেকে খাবার এলে তা খুলে গিয়ে পাকস্থলিতে প্রবেশ করানো। এরপর দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে হজমের জন্য সজোরে সংকুচিত হয়। কিন্তু ভাল্ব দুর্বল হলে বা কোনো কারণে কাজ করতে অক্ষম হলে খাবার ওপরে উঠে আসে। ফলে পাকস্থলী থেকে উলটা পথে খাবার ও পাকস্থলীতে অবস্থিত হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড এবং পিত্তরস খাদ্যনালিতে অর্থাৎ ওপরে উঠে আসে। ফলে হজম প্রক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটে। এটিই অ্যাসিড রিফ্লাক্স বা রিগারজিটেশন। এর ফলে গলা-বুক জ্বালাপোড়া করে। হায়াটাস হার্নিয়া নামক রোগেও এ সমস্যা হয়।
আরো পড়ুন:
গ্যাসের ব্যথা নাকি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বুঝবেন যেভাবে
মস্তিষ্কে টিউমার হওয়ার ৪ কারণ
কখন একে রোগ বলা হয়?
কোনো ব্যক্তির অ্যাসিড রিফ্লাক্স যদি সপ্তাহে দুদিন বা তার বেশি হয় তখন রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ এ সময় রোগীর নিত্যদিনের স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটে। চিকিৎসকরা ওষুধের পাশাপাশি তার জীবনাচরণ পরিবর্তনের পরামর্শ দেন। এ লক্ষণকে অবহেলা করা যাবে না। দেখা গেছে, রিফ্লাক্স ডিজিজে কোনো রোগী পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে ভুগতে থাকলে এবং এর চিকিৎসা না নিলে তার খাদ্যনালিতে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। খাদ্যনালি চিকন বা সরু হয়ে গিয়ে রোগীর অস্বস্তিবোধ বাড়ে এবং প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যত্যয় ঘটায়। খাদ্যনালির এ অবস্থাকে ব্যারেট ইসোগাস বলে। শতকরা ২-৩ ভাগ রোগীর এ জটিলতা হয়। খাদ্যনালীর প্রাচীরে ইরোমেন বা ক্ষয় হলেও এ সমস্যা হয়।
কাদের এ সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বেশি?
প্রথম ও প্রধান কারণ হচ্ছে যারা স্থূলকায় বা শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। আরেকটি কারণ হচ্ছে যাদের জন্মগতভাবেই এ কপাটিকা বা ভাল্বের গঠন দুর্বল। সঠিক ও পরিমিত খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্থ না হওয়াও এ রোগের কারণ। পেট ভরে খাওয়া বা মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া, খাবার তালিকায় বেশিরভাগ সময় চর্বি ও তেলজাতীয় খাবারের আধিক্য যাদের থাকে তাদের রিফ্লাক্স ডিজিজ হয়ে থাকে। জীবনাচরণের মধ্যে খাওয়ার পরপরই পানি খাওয়া, খাওয়ার পর পরই শুয়ে যাওয়া বা টাইট করে প্যান্টের বেল্ট বা পায়জামার গিঁট বাঁধা। এ ছাড়া যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল এবং যারা ধূমপান, অ্যালকোহল ও বেশি বেশি চা কফি পান করেন তাদের এ সমস্যার তীব্রতা বেশি হয়।
আরো পড়ুন:
কোন গ্রুপের রক্তের মানুষের স্ট্রোকের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি?
যেভাবে সহজে নাক ডাকা দূর করবেন
রোগ নির্ণয় পদ্ধতি:
রোগীর লক্ষণ শুনেই প্রধানত এর ডায়াগনোসিস করা হয় ও ওষুধ দেওয়া হয়। এরপরও সমস্যা না কমলে এন্ডোসকোপির মাধ্যমে অন্ন নালির পিএইচ নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া এন্ডোসকপির আপারজিআইটি পরীক্ষা কখনো করা হয়। কোনো কোনো রোগীর রিফ্লাক্স ডিজিজের সঙ্গে পেট বা ডিওডেনামে আলসার বা ঘা বা ক্ষত থাকতে পারে যাকে পিইউডি (PUD) বলে।
রোগের ম্যানেজমেন্ট
রোগীকে প্রথমেই তাদের খাদ্যাভ্যাস, বদ অভ্যাস ও জীবনাচরণের পরিবর্তনের কথা বলা হয়। সঙ্গে প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর (পিপিআই) জাতীয় ওষুধ যাকে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বলা হয় তা ৬-৮ বা ১২ সপ্তাহের জন্য দেওয়া হয়। এ ওষুধগুলোর মধ্যে রয়েছে প্যানাটোপ্লাজল, র্যাবিপ্রাজল, ইসমোপ্রাজল, ওমিপ্রাজল, ল্যানসোপ্লাজল, ডেক্সল্যানসোপ্লাজল ইত্যাদি। দিনে কখনো একবার বা দুবার এ ওষুধ দেওয়া হয়। সাধারণত সকালে নাশতা খাওয়ার ৩০ মিনিট আগে এ ওষুধ সেবনের কথা বলা হয়। বলাইবাহুল্য, বাংলাদেশের সব ফার্মাসিউটিক্যালসে এ প্রোডাক্টগুলো রয়েছে এবং এ দেশে সর্বাধিক বিক্রীত ওষুধ হচ্ছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নামে পরিচিত এ ড্রাগগুলো। এ ছাড়া রোগের লক্ষণ ও চুকা ঢেঁকুর ওঠা কমানোর জন্য খাওয়ার পর সোডিয়াম এলজিনেট ও সোডিয়াম বাইকার্বোনেট নামক সিরাপ দেওয়া হয়। যা খাওয়ার পর খেতে হয়। রাতে লক্ষণ বেশি হলে এইচ টু ব্লকার বা ফ্যামেটিডিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। পেট ব্যথা বা কামড়ালে সুকরালফেট দেওয়া হয়।
কখন সার্জারি প্রয়োজন?
২-৩ ভাগ রোগীর সার্জারি লাগে। এন্ডোসকোপির মাধ্যমে খাদ্যনালির ভেরিসেসের চিকিৎসা করা হয়। আমাদের দেশে মূলত অস্ত্রোপচারের সাহায্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর নাম ফানডোপ্লিকেশন। খাদ্যনালির মিউকাস রিসেকশন নামক অপারেশনও করা হয়। কেউ কেউ রেডিও ফ্রিকোরেন্সি অ্যাবলেশন বা ক্ষতস্থান পুড়িয়ে দেন। ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে বা ওষুধ যোগ করে এবং অবশ্যই লাইফস্টাইল পরিবর্তন করেও যদি সমাধান না হয় তবেই সার্জারি লাগে।
আরো পড়ুন:
ফুসফুস নষ্ট করে যে ৩ জিনিস
ডায়াবেটিস রোগীদের যে কাজ করা একদমই উচিত নয়
জরুরি বিষয় যা মেনে চলবেন
* পেট ভরে খাওয়া যাবে না, পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খালি রাখতে হবে। যখন পেটে চাপ বোধ করবেন বা অস্বস্তি বোধ হবে তখনোই খাবার গ্রহণ বন্ধ রাখতে হবে।
* খাওয়ার পরপরই পানি না খেয়ে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা পর তা গ্রহণ করুন। পানি গ্রহণ অবশ্যই বসে ধীরে ধীরে করবেন। খাওয়ার মাঝে বা পরপরই অল্প পানি খাওয়া যেতে পারে। তবে পেট যেন এক-তৃতীয়াংশ অবশ্যই খালি থাকে।
* ঘরে তৈরি ফ্রেশ খাবার গ্রহণ করুন। তৈলাক্ত, ভাজা-পোড়া, মসলা ও চর্বিযুক্ত এবং গ্রিল খাবার পরিহার করুন।
* ধূমপান, অ্যালকোহল পান বন্ধ করুন। চা, কফিতে সমস্যা হলে তা গ্রহণ থেকেও বিরত থাকুন। অনেকের দুধ বা দুধজাতীয় খাবারে বা চকোলেটে এ সমস্যা হয়। সেক্ষেত্রে এ খাবার বাদ দিন।
* কিছু ওষুধ যেমন-উচ্চরক্তচাপের ওষুধ ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, মানসিক অবসাদ দূর ও ঘুমের ওষুধে এ রিফ্লাক্স ডিজিজ হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
* খাওয়ার পর পরই শুতে বা ঘুমাতে যাওয়া যাবে না কিংবা শারীরিক কোনো পরিশ্রম করবেন না। খাওয়ার আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা পর ঘুমাতে যাওয়া উচিত।
* গর্ভবতীদের যেহেতু পেটের ওপর চাপ বাড়ে তাই পাকস্থলীর মুখের ভাল্ব দুর্বল হয়ে এ লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে জীবনধারার পরিবর্তন করতে পারলেই উপকার পাওয়া যায়।
* রাতে এর লক্ষণ কমানোর জন্য বালিশ ৪-৮ ইঞ্চি উঁচু করে মাথা রেখে শোয়া ভালো।
* বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে তাই এ সাবধানতা মেনে চলা উচিত।