জরায়ুমুখ ক্যান্সার ভয়াবহ প্রাণঘাতী রোগ। আপনি জানেন তো?
- নুসরাত স্বর্ণা
- জুলাই ৮, ২০১৮
জরায়ুমুখ ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার কিংবা Cervical Cancer, যা বর্তমান বিশ্বে ১২ তম পরিচিত রোগ এবং নারীদের জন্য ৪র্থ ভয়াবহ প্রাণঘাতী রোগ। ২০১২ সালে সারাবিশ্বে কেবল জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ৫২৮,০০০ জন যাদের মধ্যে ২৬৬,জন মারা যান। বিশ্বের শতকরা ৮০ ভাগ জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্তরা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অধিবাসী।
পিছিয়ে নেই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও। সমীক্ষামতে প্রতিবছর ১৩,০০০ জন নতুন নারী এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন আর মারা যাচ্ছেন প্রায় ৬৬০০ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ১৮ জন করে নারী শুধুমাত্র জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন আমাদের দেশে। প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং নারী স্বাস্থের প্রতি সচেতনতা অবলম্বন না করলে এই সংখ্যা বাড়তে পারে কয়েকগুণ। বলা হয়ে থাকে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম। তাই প্রত্যেক নারীকেই তার স্বাস্থের ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিৎ সময় থাকতেই।
জরায়মুখ ক্যান্সার এ আক্রান্তরা মূলতঃ ১৫-৪৫ বছর বয়সী মেয়ে/মহিলা। ২০ এর নিচে কিংবা ৫৫-৬০ বছর বয়সে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা খুবই কম। এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার মূল নিয়ামক “হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV)”, যার প্রধান বাহক মূলতঃ যাদের সাদাস্রাব এর সমস্যা আছে তারা। এছাড়াও বাল্যবিবাহ, অধিক সন্তান প্রসব করা, বহুগামিতা, জননাঙ্গের অপরিচ্ছন্নতা, ধূমপান [প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ], পানের সাথে জর্দাপাতা ব্যবহার, দাঁতের গোড়ায় গুল রাখা ইত্যাদিও নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। অবিবাহিত কিংবা কখনোই শারিরীক সম্পর্কে না যাওয়া মেয়েদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
হঠাৎ করে কিংবা একদিনে এই রোগ হয় না। জরায়ুর কোষ আক্রান্ত হওয়ার পর প্রায় ১০-১৫ বছর সময় লাগে রোগ প্রকাশে। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে বলা যায় অনিয়মিত ঋতুস্রাব, ঋতু সম্পূর্ণ বন্ধ হবার এক বছর পরেও রক্তস্রাব দেখা যাওয়া কিংবা ইন্টারকোর্সের পর রক্তস্রাব হওয়া। তবে এমন কোন লক্ষ্ণ দেখা গেলে সাথে সাথেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, কেননা প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসায় ক্যান্সার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
এটুকু পড়ে যারা ভাবছেন তবে কি এই প্রাণঘাতী রোগের কোন প্রতিকার কিংবা প্রতিরোধ নেই, তাদের জন্য বলছি আছে। প্রতিকার প্রতিরোধ দুটোই। আগে বলছি প্রতিরোধ নিয়ে। পৃথিবীতে কেবলমাত্র একটি ক্যান্সার এরই প্রতিরোধের টীকা মানুষ বের করতে পেরেছে আর তা এই জরায়ু ক্যান্সার এর। প্রথমবার সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সের পূর্বে যেকোন মেয়েই CERVARIX নামক তিন ডোজের এই টীকাটি নিয়ে নিতে পারেন। এটি বাংলাদেশে বাজারজাত করে GLAXO-SMITHCLINE। আমার এলাকার স্বাস্থকর্মীর কাছে জেনেছি এই টীকার প্রতি ডোজের মূল্য ২২০০ টাকা, আপনার এলাকায় হয়তো কিছুটা কমবেশী হবে। ১ম টীকাটি দেয়ার ১ মাস পর ২য়টি এবং ৬ মাস পর বুস্টার ডোজ দিতে হয়।
তারচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ভ্যাক্সিনটি দিতে পারবেন পুরুষরাও। পুরুষ সঙ্গী ভ্যাক্সিন নিলে তার স্ত্রীর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। যারা ভাবছেন জরায়ুর ভ্যাক্সিন কি জরায়ুতেই দিতে হয় উত্তর হচ্ছে না, মাথা ব্যথা হলে কি মাথা কাটতে হয়? এই ভ্যক্সিন দেয়া হয় হাতে, টিটি টীকার মতোই। তবে গর্ভবতী মায়েরা কখনোই এই ভ্যাক্সিন নিতে পারবেন না। যদি আপনার বয়স ২৫ কিংবা তার বেশী হয় এবং আপনি বিবাহিত হয়ে থাকেন তাহলে ভ্যাক্সিনেশনের পূর্বে অবশ্যই জরায়ু পরীক্ষা করে নিবেন, নয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে।
এছাড়াও প্রতিরোধের আরো একটি ব্যবস্থা হচ্ছে প্রতি তিনবছর পর পর স্বাস্থ্যকর্মী কিংবা চিকিৎসক দ্বারা জরায়ু পরীক্ষা করা। এটি কোন সার্জিকাল পদ্ধতি নয়, বরং উনারা খালি চোখেই দেখতে পান আপনার জরায়ুতে কোন চাকা বা ক্ষত আছে কিনা। থাকলে কালক্ষেপন না করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে, কেননা এই পর্যায়ে চিকিৎসায় জরায়ু কেটে ফেলার প্রয়োজন পড়ে না এবং পরবর্তীতে সন্তানধারণ সম্ভব। বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে ২৫ বছর বয়সের পর থেকে নিয়মিত ভাবে এই টেস্ট করা আবশ্যক।
দ্রুত রোগ ধরা পড়লে জরায়ু ফেলে দেওয়ার মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে তবে রোগ ছড়িয়ে পরলে কেমোথেরাপি এবং রেডিও থেরাপির সাহায্য নেওয়া হয়। তবে প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকার সবসময়ই উত্তম। তাই মেয়েদের যৌনসাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা এবং জননাঙ্গের পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পিরিয়ডের সময় নিরাপদ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার, কাপড় কিংবা তুলা যথসম্ভব পরিহার করা, এছাড়াও কাপড় তুলা ন্যাপকিন যাই ব্যবহার করা হোক তা কখনোই ৬-৮ ঘন্টার বেশি রাখা যাবে না- এই ব্যাপারগুলোতে জোর দিতে হবে। একইসাথে নিজেকে থাকতে হবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মনে রাখতে হবে ভ্যাক্সিনেশন কখনোই HPV দ্বারা ইনফেকশন ও ক্যান্সার সারায় না, বরং ইনফেকশন থেকে বাঁচায়। তাই টীকা দিতে হবে ইনফেকশন হওয়ার আগেই।
বর্তমান বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, আবার অপরদিকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পরে সার্ভাইভ করা যায় প্রায় ৫ বছর পর্যন্ত। তাই ভীত, লজ্জিত না হয়ে নিয়মিত নিজের জরায়ুমুখ পরীক্ষা করান, ভ্যাক্সিন নিন এবং মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি নিজের প্রতি সচেতন হো। আর পুরুষদের বলছি, জড়তা ভেঙে নিজের মা-বোন কিংবা স্ত্রীকে আপনিই নাহয় নিয়মিত ডাক্তারবাড়ি/স্বাস্থকেন্দ্রে নিয়ে যান। আমাদের সবার সচেতনতাই যথেষ্ট এমন একটি প্রাণঘাতী রোগ থেকে নিজেকে ও নিজের আশেপাশের মেয়েদেরকে সুরক্ষা দিতে।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া এবং গুগল করে পাওয়া জরায়ুমুখ ক্যান্সার সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখা।