গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা প্রিভিয়া জটিলতায় আপনার করণীয় কী ?
- ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
- ডিসেম্বর ৩, ২০১৭
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এখন গর্ভবতী নারীরা প্লাসেন্টা প্রিভিয়া জটিলতায় ভোগেন, সহজ বাংলায় বলতে গেলে গর্ভফুল নিচের দিকে থাকা। গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরে প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল তৈরি হয়, যা জরায়ুর ভেতরের দেয়ালে লেগে থাকে। মা ও ভ্রূণের যোগাযোগ এই গর্ভফুলের মাধ্যমে হয়। ভ্রূণকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগানোর ব্যবস্থা করে এই গর্ভফুল, আম্বিলিকাল কর্ডের মাধ্যমে। এখন এই গর্ভফুল বা প্লাসেন্টাটি সাধারণত জরায়ুমুখের চেয়ে অনেক দূরে উপরের দিক থেকে লেগে থাকে। কিন্তু গর্ভফুলটি যদি জরায়ুর একদম নিচের দিকে বা জরায়ুমুখে লেগে থাকে, তাহলে এই মেডিকেল কন্ডিশনকে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বলে।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া হলে গর্ভস্থ সন্তানের মাথা সাধারণত সঠিক অবস্থানে থাকে না , বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাথা উপরের দিকে বা আড়াআড়ি থাকতে দেখা যায় , যেটাকে বলা হয় ব্রীচ পজিশন। এবং এ সমস্যায় সাধারণত গর্ভবতী নারীরা স্পটিং (Spotting) বা হালকা থেকে ভারী রক্তপাতের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। কিন্তু এ রক্তপাতের সময় কোন ব্যথা অনুভূত হয় না। যদিও এমনটি হলে সাথে সাথে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং তার নির্দেশমত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া সাধারণত তিন রকমের হয় :
(১) যদি গর্ভফুল জরায়ুমুখকে পুরোপুরি ঢেকে রাখে তাহলে সেটা হলো কম্পলিট/টোটাল প্লাসেন্টা প্রিভিয়া (Complete/Total Placenta Previa)।
(২) যদি গর্ভফুল জরায়ুমুখকে আংশিক ঢেকে রাখে, সেটাকে বলা হয় মার্জিনাল বা পার্শিয়াল প্লাসেন্টা প্রিভিয়া (Marginal/Partial Placenta Previa)।
(৩) আর যদি জরায়ুমুখের ২ সেন্টিমিটারের মধ্যে থাকে গর্ভফুলটি, কিন্তু জরায়ুমুখকে ঢেকে রাখেনি, এই সমস্যাকে বলা হয় লো লায়িং প্লাসেন্টা (Low Lying Placenta)।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা লো লায়িং প্লাসেন্টা হলে কি হতে পারে ?
এটা নির্ভর করে আপনি গর্ভধারণের কোন পর্যায়ে আছেন তার উপর। যদি ১৬ থেকে ২০ সপ্তাহের আলট্রাসাউন্ড এ প্লাসেন্টা প্রিভিয়া ধরা পরে তাহলে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। সময় বাড়ার সাথে সাথে টা জরায়ুর মুখ থেকে সরে যেতে পারে এবং আর কোন সমস্যার সৃষ্টি নাও করতে পারে। যেহেতু প্লাসেন্টা জারায়ুর সাথে সংযুক্ত থাকে তাই তা অবস্থান পরিবর্তন করেনা। জরায়ুর আকার বাড়ার সাথে সাথে তা মুখ থেকে দূরে চলে যায়। আর যেহেতু প্লাসেন্টা আকারে বাড়ে তাই সম্ভাবনা বেশী যে তা জারায়ুর উপরের দিকে বাড়বে যেখানে রক্ত সরবরাহ বেশী থাকে।
যদি দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার আপনার প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা লো লায়িং প্লাসেন্টা পাওয়া যায় তাহলে তৃতীয় ট্রাইমেস্টার এ আবার ফলোআপ করা হবে। যদি এ সময়ে আপনার যোনি পথে রক্তক্ষরণ হয় তবে আলট্রাসাউন্ড করে দেখার পরামর্শ দেয়া হবে।
খুব কম মায়েদের ক্ষেত্রেই শিশুর জন্মের সময় প্লাসেন্টা প্রিভিয়া থাকে যাদের ২০ সপ্তাহের আলট্রাসাউন্ড এ মারজিনাল প্রিভিয়া পাওয়া যায়। টোটাল বা কমপ্লিট প্রিভিয়ার ক্ষেত্রে প্রসবের সময়ও তা একই অবস্থায় থাকে। সাধারণত প্রতি ২০ জনে ১ জনের লো লায়িং প্লাসেন্টা থাকে।
যদি ফলোআপ আলট্রাসাউন্ড এ আপনার প্লাসেন্টা প্রিভিয়া পাওয়া যায় তাহলে আপনাকে বিশ্রাম এর পরামর্শ দেয়া হবে। এ সময় শারীরিক মিলন বা জার্নি করতে মানা করা হয়। এমনকি যোনি পথের কোন ধরনের পরীক্ষাও করা হয়না। সবধরনের ভারী কাজ এ সময় নিষিদ্ধ যেগুলোর কারণে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রসবের সময় সি-সেকশন করতে হয় কারণ প্লাসেন্টা আপনার জরায়ুর মুখ সম্পূর্ণ বন্ধ করে রাখে। প্রসবের সময় মারজিনাল প্লাসেন্টা থাকলে ও সি-সেকশনের পরামর্শ দেয়া হয় কারন জরায়ুর মুখ বড় হওয়ার সাথে সাথে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে।
এ ধরনের লো লায়িং প্লাসেন্টার ক্ষেত্রে তৃতীয় ট্রাইমেস্টার এ আপনার ব্যাথাহীন রক্তপাত হতে পারে। এ অবস্থায় আপনাকে হসপিটালে ভর্তি হতে হবে। পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করবে আপনি গর্ভধারণের কোন পর্যায়ে আছেন, রক্তপাতের পরিমান এবং আপনার ও শিশুর অবস্থার উপর। যদি আপনি গর্ভধারণের ফুল টার্ম এ থাকেন তবে তৎক্ষণাৎ সি-সেকশন এর মাধ্যমে বাচ্চা ডেলিভারির সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
যদি বাচ্চার কন্ডিশন খারাপ থাকে এবং রক্তক্ষরণ বেশী হয় এবং বন্ধ করা সম্ভব না হয় তবে বাচ্চা প্রিম্যাচিউর থাকলেও সি-সেকশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। যদি অবস্থা খুব একটা খারাপ না হয় তবে আপনার আরও কিছু দিন হসপিটাল এ রাখা হবে অবজারভেশন এর জন্য।
যদি রক্তপাত বন্ধ হয়ে যায় এবং আপনার এবং শিশুর অবস্থা ভালো থাকে তাহলে হয়তোবা আপানাকে বাসায় যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। কিন্তু কোন কারণে রক্তপাত শুরু হলে অবশ্যয় অতি দ্রুত আবার হসপিটাল এ আসতে হবে।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া হলে আর কি কি জটিলতা দেখা দিতে পারে?
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বা লো লায়িং প্লাসেন্টা হলে আপনাকে রক্ত দিতে হতে পারে কারণ প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এটা শুধুমাত্র গর্ভধারণের সময়ই নয়, এমনকি প্রসবের সময় ও প্রসবের পরেও হতে পারে। এর কারণ হলো যখন সি-সেকশন করা হয় তখন বাচ্চার সাথে সাথে প্লাসেন্টা ও বের করে ফেলা হয় এবং মাকে Pitocin দেয়া হয় যা জরায়ুকে সঙ্কুচিত করে এবং প্লাসেন্টার স্থানে রক্ত বন্ধ করতে সাহায্য করে। কিন্তু প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার ক্ষেত্রে প্লাসেন্টা জরায়ুর নিচের দিকে থাকে যা জরায়ুর উপরের অংশের মত অতোটা সঙ্কুচিত হয়না। যার ফলে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়না।
প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার ক্ষেত্রে প্লাসেন্টা জরায়ুর অনেক ভেতরে গাঁথা থাকতে পারে যা খুব সহজে প্রসবের সময় বের করা যায়না। এর ফলে ওই স্থান থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয় এবং বেশ কয়েকবার রক্ত দেয়ার প্রয়োজন পরতে পারে। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এমনকি রক্তপাত বন্ধের জন্য hysterectomy করার প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়াও এসব ক্ষেত্রে প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চার অনেক ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে যেমন- শ্বাসকষ্ট বা ওজন কম হওয়া।
সাধারণত কারা থাকেন প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার ঝুঁকিতে ?
বর্তমানে এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, প্রতি ২০০ জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে অন্তত একজন এই প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার সমস্যায় আক্রান্ত। যদিও প্লাসেন্টা প্রিভিয়া কেন হয়, এইটার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো অজানা, কিন্তু কিছু কিছু বিষয় এ সমস্যাকে ট্রিগার করে বলে মেডিকেল সায়েন্সে বলা হয় সেগুলো হলো –
(১) পূর্বে সিজারিয়ান ডেলিভারি হলে।
(২) বয়স ৩৫ এর অধিক হলে।
(৩) জরায়ুতে পূর্বে কোন সার্জারি করা হলে।
(৪) পূর্বে চারবারের বেশি সন্তান জন্মদান করলে।
(৫) ধূমপান এবং মাদকদ্রব্য সেবন করলে।
(৬) গর্ভে দুই বা ততোধিক সন্তান একসাথে থাকলে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রেগন্যান্সির থার্ড ট্রাইমেস্টার আসতে আসতে প্লাসেন্টা তার সঠিক পজিশনে চলে যায়। এজন্য ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী নিয়মিত মেডিকেল চেক আপ করাতে হবে এবং আল্ট্রাসাউন্ড করলে জানা যাবে যে বর্তমানে প্লাসেন্টার পজিশন কি ! কিন্তু যদি আপনার ঘনঘন ভ্যাজাইনাল ব্লীডিং হয়, এবং আল্ট্রাসাউন্ডে দেখা যায় যে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া আছে, তাহলে হয়তো ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী –
– আপনাকে পুরোপুরি বেডরেস্টে থাকতে হতে পারে।
– ভারী কাজ এবং জার্নিতে নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে।
– ফিজিক্যাল ইন্টারকোর্সেও নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে।
যদি থার্ড ট্রাইমেস্টারে ও প্লাসেন্টার পজিশন ঠিক না হয়, তাহলে হয়তো ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী আপনাকে সি সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদান করাতে হতে পারে। কারণ গর্ভফুল যদি জরায়ুমুখকে পুরোপুরি ঢেকেই রাখে তাহলে গর্ভস্থ শিশুর বের হওয়ার প্রক্রিয়াতে টিয়ারিং হয়ে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে , যা মা ও সন্তান উভয়ের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। তবে যদি গর্ভফুল আপনা আপনি সঠিক অবস্থানে চলে যায় (যা আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে জানা সম্ভব), তাহলে নর্মাল ভ্যাজাইনাল ডেলিভারি সম্ভব।
সূত্র : myfairylandbd