মানসিক উদারতা নিশ্চিত করে একসাথে বাঁচা

  • জান্নাতুন নুর দিশা
  • এপ্রিল ১২, ২০১৯

এলাকার এক ভদ্রমহিলা প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতেন আমার মায়ের সাথে গল্প করতে। তিনি বয়সে আমার মায়ের বয়সী। তিনি তার জীবনের এক তিক্ত অভিজ্ঞতার গল্প একবার শেয়ার করছিলেন আমার মায়ের সাথে। ওনার বিয়ের তিন বছর ওনার স্বামী বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। অনেক কষ্টে তিনি স্বামীকে ফিরিয়ে আনেন সে সম্পর্ক থেকে। 

ওনার বিয়ের পরপর তার শাশুড়ি, ননদেরা ওনাকে স্বামীর সাথে একান্ত সময় কাটাতেই দিতে চাইতেন না। সারাদিন অফিস করে ওনার স্বামী অফিস থেকে ফিরে ওনাকে ডাকতেন। দেখা যেতো রুমের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ওনারা দুজন বসে শুধুমাত্র গল্পই করছেন, ওনার শাশুড়ি, ননদেরা নিজেরা নানা কথা দিয়ে বুঝাতে চাইতেন, স্বামী আসলেই তিনি সংসারের কাজ বাদ দিয়ে দরজা বন্ধ করে রুমে ঢুকে যান। 

অন্য সময়ও তারা এসব নিয়ে হাসাহাসি, কুৎসিত রসিকতাসুলভ কথাবার্তা বলতো। তখন ওনার বয়স আঠারো। খুব ম্যাচিউরড ছিলেন না তিনি। শাশুর, ননদদের এসব ইঙ্গিতপূর্ণ কথায় ওনার লজ্জা হতো খুব। যেন স্বামীকে সময় দেয়া অপরাধ!  তিনি এদের কথায় অতিষ্ঠ হয়ে স্বামী ফিরলেও রুমে যেতেন না। যেতেন অনেক রাত করে। ওনার স্বামী রাগ করতো। আবার স্বামীর মন রাখতে গেলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলতো "নিজের জামাই আসলেই বউ সংসারের কাজ বাদ দিয়ে রুমে ঢুকে বসে থাকে।" 

এসবের কারণে নানা জটিলতায় তার স্বামীর সাথে তার মানসিক দূরত্ব বাড়ে। সেই আন্টি বলছিলেন, "আমার স্বামী একদিন বললেন, একটা লাল শাড়ি পরো, চল কোথাও ঘুরে আসি। কিন্তু আমার শাশুড়ি মেহমান আসবে এই অজুহাতে যেতে দেন নি।" স্ত্রীকে মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে কাছে না পেতে না পেতে তার স্বামী অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। তারপর আবার এই শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই ওনার স্বামীকে বুঝানোর পরিবর্তে ওনাকে বলতেন, "কেমন মহিলা যে স্বামীর মন যোগাতে পারো নাই!" 

উনি অনেক কষ্টে পরবর্তীতে সংসার বাঁচান। হয়তো এখনকার কোনো স্বাবলম্বী মেয়ে হলে এত কঠিন পরিস্থিতি সহ্য করে নিজের আত্মসম্মান বিলিয়ে দিয়ে সে সংসারে থেকে যেতো না। তিনি অসহায় ছিলেন বলে সহ্য করেছিলেন। আসলে যৌথ পরিবারে থাকবার অনেক ভালো দিক আছে। কিন্তু এসব সমস্যা এড়াতে আজকাল অনেকেই যৌথ পরিবারে থাকতে চান না। অথচ একটু উদারতা আর সহমর্মিতা পেলে এখনো অনেকে যৌথ পরিবারে থাকতেন। 

অনেক পরিবারই সন্তানের বিয়ের পর তাদের প্রাইভেসি বিষয়ে সচেতন থাকেন না। আমার এক কলিগ বলেছিলেন, তার বিয়ের পর তাকে যে রুম দেয়া হয়েছিলো, সেটার দরজাই ছিলো ভাঙা। যে রুমে সাতমাস থাকবার পর সে বিরক্ত হয়ে এবং রাগ থেকে আলাদা বাসা নেয়। আমার এক কাজিনের বিয়ের পর বাসার ছোট স্টোররুম সংস্কার করে তাদের রুম হিসেবে দেয়া হয়। এমনকি অনেক পরিবার ছেলে, ছেলের বউকে দূরে কোথাও ঘুরতে যাবার অনুমতিও দেয় না। 

প্রথম জীবনে যারা যৌথ পরিবারে কাটিয়েছেন, অনেকেই এসব কমন অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। আমাদের দেশে সাধারণত ব্যাচেলর ছেলেদের জন্য সংসারে সুসজ্জিত কোনো কামরা থাকে না। অনেক সংসারে ভাইয়েরা একসাথেই থাকে। বউ আসলে তাকে একটা সুসজ্জিত কামরা দেবার দায়িত্বজ্ঞান না থাকলে, তাদের পর্যাপ্ত প্রাইভেসি দেবার মানসিক উদারতা না থাকলে, প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারী বিয়ের পর নিজেদের জন্য কিছু একান্ত সময় তাদের প্রয়োজন হয় এসব বুঝবার মত মানসিক পরিপক্বতাহীন শ্বশুরপক্ষ যদি অভিযোগ আনে তাদের সন্তানেরা যৌথ পরিবারে থাকতে আগ্রহী না, সে অভিযোগ কতটুকু গ্রহণযোগ্য? 

 

Leave a Comment