গর্ভাবস্থায় মূত্রনালীর সংক্রমন কি, এর কারণ এবং প্রতিকার
- ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
- জানুয়ারি ২৩, ২০১৮
ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা মূত্রনালীর সংক্রমণ কি?
আমাদের শরীরের দুটি কিডনি ( যেখানে মূত্র উৎপন্ন হয়) , দুটি ইউরেটার (যার মাধ্যমে মূত্র কিডনি থেকে ব্লাডারে আসে), একটি ইউরিনারি ব্লাডার বা মূত্রথলি( যেখানে মূত্র জমা হয়) এবং ইউরেথ্রা বা মূত্রনালি (যার মাধ্যমে মূত্র শরীর থেকে বেড়িয়ে যায়) নিয়ে মূত্রতন্ত্র গঠিত। মূত্রতন্ত্রের যেকোনো অংশে জীবাণু সংক্রমণ হলে তাকে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা মূত্রনালীর সংক্রমণ বলে। কিডনি, মূত্রনালি বা মূত্রথলি অথবা একাধিক অংশে একসঙ্গে ইনফেকশন হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় যদি এ সংক্রমণ হয়, আর এর যদি চিকিৎসা না হয়, একদিকে মায়ের যেমন ক্ষতি হতে পারে, গর্ভজাত সন্তানও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার মৃত্যু হতে পারে। কাজেই বারবার ইউটিআই হলে অনেক ক্ষতি হতে পারে। এটি বারবার হতে থাকলে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা মূত্রনালীর সংক্রমণ সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে যা শরীরের চামড়া, যোনী বা মলদ্বার হতে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। বেশ কয়েক ধরনের ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন দেখা যায়, যেমন-
Cystitis বা ব্লাডার ইনফেকশন : শরীরে প্রবেশের পর ব্যাকটেরিয়া বেশীরভাগ সময় ব্লাডারে অবস্থান করে এবং সেখানেই বংশবিস্তার করতে থাকে। এর ফলে ব্লাডারে প্রদাহ সহ ইনফেকশনের অন্যান্য লক্ষনগুলো দেখা দেয়।
কিডনি ইনফেকশন : ব্যাকটেরিয়া ব্লাডার থেকে ইউরেটার এর মাধ্যমে কিডনি পর্যন্ত পৌছাতে পারে এবং একটি বা দুটি কিডনিকেই ইনফেকটেড করতে পারে। কিডনি ইনফেকশন(pyelonephritis) গর্ভাবস্থায় একটি মারাত্মক জটিলতা। এটি কিডনি থেকে রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিডনি ইনফেকশন গর্ভের শিশুর জন্য ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
Asymptomatic bacteriuria : মাঝে মাঝে ইউরিনারি ট্র্যাক্টে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটতে পারে কিন্তু এর কোন লক্ষন বোঝা যায় না। একে Asymptomatic bacteriuria বলে। গর্ভবতী না থাকা অবস্থায় এটি তেমন কোন ক্ষতি করেনা এবং নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু গর্ভাবস্থায় তা কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর ফলে প্রি-টার্ম লেবার ও কম ওজনের বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ কারনেই গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ইউরিন টেস্ট করা হয়।
গর্ভাবস্থায় ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের কারণ : সব মেয়েরাই ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ঝুঁকিতে ছেলেদের তুলনায় বেশী থাকে কারণ মেয়েদের ইউরেথ্রা বা মূত্রনালি ছেলেদের তুলনায় ছোট হয় যার ফলে ব্যাকটেরিয়া সহজে ব্লাডারে প্রবেশ করতে পারে। গর্ভাবস্থায় এর ঝুঁকি আরও বেড়ে যায় কারণ এ সময় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ব্যাকটেরিয়ার ইউরিনারি ট্র্যাক্টে পৌঁছান সহজ হয়। এ ছাড়াও গর্ভাবস্থায় বর্ধিত জরায়ু ব্লাডারের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে যার ফলে প্রস্রাব করার সময় মায়েদের ব্লাডার পুরোপুরি খালি হয়না। ফলে ব্যাকটেরিয়া বংশবিস্তার করার অনেক সময় পায়।
ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে প্রধানত দায়ী ই. কোলাই ( ইশচেরিকিয়া কোলাই)। ই. কোলাই মানুষের পরিপাক তন্ত্রের স্বাভাবিক অণুজীব। এটি পায়ুপথ হতে মূত্রনালিতে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়। যেহেতু ইউরেথ্রা পায়ুপথের কাছাকাছি অবস্থান করে তাই মলত্যাগের সময় এ ব্যাকটেরিয়া পায়ুপথ হতে ইউরেথ্রার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। গর্ভাবস্থায় শারীরিক মিলন যদিও কোন ক্ষতি করেনা তবু একটা সম্ভাবনা থাকে যাতে মিলনের সময় নারীর যোনীর আশে পাশে থাকা ব্যাকটেরিয়া ভেতরে ঢুকে যায়। এ ছাড়াও আরও কিছু কারণে এই ইনফেকশন হতে পারে। এগুলো মধ্যে যে কোনটি থাকলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। এগুলো হোল-
(১) আগে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ইতিহাস থাকলে।
(২) ম্যাটারনাল ডায়াবেটিস থাকলে
(৩) Sickle cell disease থাকলে।
(৪) কিডনি সংক্রান্ত সমস্যা থাকলে।
(৫) ইউরিনারি ট্র্যাক্টে কোন সার্জারি থাকলে।-
(৬) ব্লাডার ইনফেকশনের লক্ষণগুলো কি?
(৭) ব্লাডার ইনফেকশনের লক্ষন একেকজনের একেকরকম হতে পারে। সাধারণ লক্ষন গুলো হোল-
(৮) প্রশ্রাবের সময় বা শারীরিক মিলনের সময় ব্যাথা, অস্বস্তি বা জ্বালাপোড়া করা।
(৯) পেলভিসে অস্বস্তিবোধ হওয়া বা তলপেটে ব্যাথা।
(১০) ঘনঘন প্রস্রাব পাওয়া বা নিয়ন্ত্রন করতে না পারা। যদি প্রস্রাবের পরিমান অনেক কম থাকে।
(১১) এছাড়াও প্রস্রাবে দুর্গন্ধ হতে পারে এবং প্রস্রাব ঘোলা হতে পারে। প্রস্রাবে রক্ত থাকতে পারে এবং শরীরের তাপমাত্রা হালকা বৃদ্ধি পেটে পারে।
(১২) যেহেতু গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়া স্বাভাবিক তাই ইনফেকশনে লক্ষন আপনি নাও বুঝতে পারেন যদি না আর কোন লক্ষন দেখা না যায়। তাই কোন কারণে যদি মনে হয় আপনার ইনফেকশন হয়েছে তাহলে দ্রুত ডাক্তারকে জানান।
কিডনি ইনফেকশনের লক্ষন গুলো কি কি ? কিডনি ইনফেকশনের লক্ষনগুলো হঠাৎ দেখা দিতে পারে। লক্ষণগুলো হলো -
(১) শরীরের উচ্চ তাপমাত্রা ( গায়ে কাঁপুনি ধরতে পারে, শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যেতে পারে বা ঘাম হতে পারে)
(২) পিঠের নীচের দিকে বা পাশে পাঁজরের ঠিক নীচে ব্যথা হতে পারে। ব্যাথা একপাসে বা দুপাশেই হতে পারে আবার পেটে ও ব্যাথা হতে পারে।
(৩) বমি বমি ভাব হতে পারে বা বমি হতে পারে।
(৪) প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে পারে
(৫) ব্লাডার ইনফেকশনের কিছু কিছু লক্ষন ও দেখা দিতে পারে।
(৬) যদি কিডনি ইনফেকশনের কোন লক্ষন দেখা যায় তাহলে সাথে সাথে ডাক্তারকে জানাতে হবে।
যদি ইনফেকশনের কোন লক্ষন দেখা না যায় বা Asymptomatic bacteriuria হয় তাহলে কি হবে?
যদি Asymptomatic bacteriuria হয়ে থাকে যার কোন লক্ষন দেখা যায়না এবং যদি তার চিকিৎসা করা না হয় তবে তা থেকে কিডনিতে ইনফেকশন ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। তবে এর চিকিৎসা করা হলে ইনফেকশনের সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। সাধারনত প্রথম প্রি-ন্যাটাল ভিজিটেই এর কোন লক্ষন আছে কিনা তা জানার জন্য ইউরিন টেস্ট করা হয়। যদি প্রাথমিক অবস্থায় এর রেসাল্ট নেগেটিভ আসে তাহলে গর্ভাবস্থায় ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের সম্ভাবনা কম থাকে। যদি রেসাল্ট পসিটিভ আসে তাহলে গর্ভাবস্থায় নিরাপদ অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ করলে সাধারনত ইনফেকশন সেরে যায়। কোর্স শেষ হওয়ার পর আবার ইউরিন টেস্ট করে দেখা হয় ইনফেকশন সেরেছে কিনা। গর্ভাবস্থায় সাধারনত ইনফেকশনের লক্ষন আছে কিনা দেখার জন্য বেশ কয়েকবার ইউরিন টেস্ট করা হয়।
ব্লাডার ইনফেকশনের চিকিৎসা : ব্লাডার ইনফেকশনের ক্ষেত্রেও একই ভাবে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। তবে মনে রাখতে হবে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স অবশ্যয় শেষ করতে হবে যাতে ব্যাকটেরিয়া পুরোপুরি দূর হয়ে যায়। এর পর পুরো গর্ভাবস্থায় নিয়মিত টেস্ট করা হবে যায় এর কোন লক্ষন দেখা দিলে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেয়া যায়।
কিডনি ইনফেকশনের চিকিৎসা : কিডনি ইনফেকশনের ক্ষেত্রে হসপিটালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এ সময় মাকে এবং গর্ভের শিশুকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। যদি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মৃদু ইনফেকশন ধরা পড়ে, চিকিৎসায় অবস্থার উন্নতি হয় এবং প্রি-টার্ম লেবারের সম্ভাবনা না থাকে তবে হয়তো আপনাকে ডিসচার্জ করে দেয়া হবে এবং অ্যান্টিবায়োটিক চালিয়ে যেতে বলা হবে। যদি অবস্থা আরও খারাপ থাকে তাহলে আরও কিছু সময় হসপিটালে থাকতে হতে পারে। ইনফেকশন ভালো হয়ে যাওয়ার পর গর্ভাবস্থার শেষ পর্যন্ত কম ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হতে পারে যাতে ইনফেকশন আবার ফিরে না আসে।
ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন প্রতিরোধে করনীয় : সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল নিয়মিত এবং পরিমিত পানি পান করা। সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে পানি পানের অভ্যাস করা উচিত। দিনে অন্তত ১০ গ্লাস পানি খাওয়ার চেষ্টা করুন যাতে প্রস্রাব পরিষ্কার বা হালকা হলুদ বর্ণের থাকে। এটি শরীর হাড্রেটেড থাকার লক্ষন। প্রস্রাব আটকে না রাখা। এই বাজে অভ্যাস যাদের আছে তাদের প্রায়ই ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা মুত্রনালীর সংক্রমণ হওয়ার আশংকা থাকে। প্রস্রাবের সাথে আমাদের শরীরের ব্যাকটেরিয়া বেড়িয়ে যায়। প্রস্রাব করার সময় ব্লাডার পুরোপুরি খালি করে ফেলার চেষ্টা করুন।
মলত্যাগের পর পায়ুপথ সামনে থেকে পিছন দিকে পরিষ্কার করুন। এতে পায়ু পথে থাকা ব্যাকটেরিয়া ইউরেথ্রার সংস্পর্শে আসতে পারবেনা।
যৌনাঙ্গ পরিষ্কার রাখুন। সুগন্ধিযুক্ত বা ক্যামিকেলযুক্ত সাবান ব্যাবহার করা থেকে বিরত থাকুন। ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা মুত্রনালীর সংক্রমণ হলে অনেক ডাক্তারই রোগীদেরকে দৈনিক ৫০০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ভিটামিন সি মুত্রথলীকে ভালো রাখে এবং প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া ভাব কমাতে সহায়তা করে। এছাড়াও ভিটামিন সি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করতে সহায়তা করে। তাই ইউরিন ইনফেকশন হলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার খান।
হট টাব বা বাথ টাব এ গোসল না করে শাওয়ার নেয়ার চেষ্টা করুন। গোসলের পর যৌনাঙ্গ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে এবং শুষ্ক রাখতে হবে। সুগন্ধি যুক্ত ও রুক্ষ সাবান পরিহার করুন। টাইট জামাকাপড় এড়িয়ে চলুন। কারণ এই ধরনের পোশাক বায়ু চলাচলে বাধা তৈরি করে।
Douche ব্যাবহার করা থেকে বিরত থাকুন। এমনিতেও গর্ভাবস্থায় Douche এর ব্যবহার উচিত নয়। Cranberry জুস খেতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে cranberry জুস ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা কমায় এবং নতুন ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে বাঁধা দেয়।
তথ্য এবং ছবি : গুগল