ছেলেদের চুলের যত্নে প্রয়োজনীয় কিছু কার্যকরী টিপস
- ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
- জানুয়ারি ৮, ২০১৮
চুলের সমস্যা ছেলেদেরও কম নয়। কিন্তু চুলের যত্নের ব্যাপারে অনেক ছেলেই উদাসীন থাকে। এতে পরবর্তীতে গিয়ে তাদের চুলে নানা ধরণের সমস্যা দেখা যায়। তারা মনে করে শুধু মেয়েদের চুলের যত্নের প্রয়োজন। কিন্তু নারীদের চাইতে পুরুষের মাথার ত্বকের ধরণ আলাদা। তাই পুরুষের চুলের বাড়তি যত্ন নিতে হয় কিছুটা বেশি। চুল পড়ার সমস্যা ছেলেদের অনেক বেশী হয়। এছাড়াও আছে চুল রুক্ষ হয়ে যাওয়া, চুলের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, তেলতেলে চুল, খুশকি ইত্যাদি হরেক রকম। এতো সমস্যা থাকলেও ছেলেদের চুলের নানা সমস্যার সমাধানও আছে। আর ছেলেরা যেহেতু বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে এতে তাদের চুলের অধিক যত্ন প্রয়োজন। চলুন জেনে নেই পুরুষের চুলের যত্নে দারুণ কার্যকরী কিছু উপায়, যা চুল পড়া ও খুশকি প্রতিরোধ করবে এবং মলিন আর বিবর্ণ চুলকে সুন্দর করে তুলবে।
টাক পড়া :
টাক পড়া ছেলেদের অন্যতম একটি সমস্যা। প্রায় একই কারণে মাথায় টাক পড়া ও চুল পাকা হয়ে থাকে। আজকাল অল্প বয়সী ছেলেদের মধ্যেও টাক পড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অল্প বয়সে টাক পড়ার নানা কারণ আছে। টাক পড়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেশিয়া বলা যায়, যা কপালের দুই পাশে রগের কাছ থেকে শুরু হয়। তারপর ক্রমেই বাড়তে থাকে মাথার সামনের দিকে এবং এটা আস্তে আস্তে পেছনের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন পুরো মাথার চুল পড়ে যায়। বংশগত বা হরমোনজনিত কারণে এটি হতে পারে। আবার বয়ঃসন্ধিকাল থেকেও কারো কারো টাক পড়া শুরু হয়ে যায়। এছাড়া অল্প বয়সে চুল পড়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ। রক্তস্বল্পতা, ওজন কমানোর জন্য খাওয়া-দাওয়া একদম কমিয়ে দেয়াও চুল পড়ার কারণ হতে পারে। টাক পড়া দীর্ঘস্থায়ী অসুখ। অনেক কারণে মাথায় টাক পড়তে পারে। চুলের পুষ্টি আসে ত্বকের পুষ্টি থেকে। ত্বকের পুষ্টির জন্য আমাদের ভালো খাবার খেতে হবে। চুলের পুষ্টির কারণেও অনেক সময় মাথায় টাক পড়ে। বংশগত কারণেও টাক পড়ে। তাছাড়া চুল ভালোভাবে পরিষ্কার না করা, দুশ্চিন্তা করা ইত্যাদি কারণে মাথায় টাক পড়ে থাকে। কিছু জিনিস ভালোভাবে মেনে চললে মাথায় টাক পড়া কিছুটা কমে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ট্রিটমেন্ট ভালো কাজ করবে।
চুল পাকা :
অনেক সময় অল্প বয়সে চুল পেকে যায় বা সাদা হয়ে যায়। অনেক কারণে অল্প বয়সে চুল পেকে যেতে পারে। চুলের গোঁড়ায় থাকা মেলানোসাইটের কারণে চুলের রং কালো হয়ে থাকে। বিভিন্ন কারণে মেলানোসাইট ক্ষতিগ্রস্ত হলেই চুল সাদা হয়ে যায়। অনেক সময় চুলের গোঁড়ায় খাদ্য ও অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে অল্প বয়সে ছেলেদের মাথার চুল পেকে যায় বা সাদা হয়ে যায়। তবে পাকা চুলের ব্যাপারে বংশগত ধারা একটি বিরাট কারণ। পাকা চুল ঢাকতে চুলে কালার করা যেতে পারে। একবার চুল পাকলে তার প্রতিকার করা যায় না। তবে হেয়ার ট্রিটমেন্ট চুল পাকা থেকে কিছুটা রোধ করে। চুল পাকা কমাতে হরীতকী, মেহেদিপাতা ভালোভাবে ফুটিয়ে টনিক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। এতে চুল পাকা কমে যেতে পারে। এছাড়া জবা ফুল বাটা, গন্ধরাজ বাটা, আমলা বাটা একসাথে মিশিয়ে চুলে লাগালে চুল কালো ও উজ্জ্বল হয়।
চুল পড়ার কারণ :
চুল পড়ার অনেক বড় একটি সমস্যা ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্য। আর চুল পড়ার কারন সর্বদা দুশ্চিন্তা, ভয়, আশংকা, অশান্তির মধ্যে কাটালে অনেক সময় চুল পড়ে যেতে পারে। টাটকা শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি পরিমাণমতো না খেলে চুল পড়ে বা পেকে যেতে পারে। নিয়মিত ব্যায়াম, কায়িক পরিশ্রম না করলে শরীরের রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। ফলে চুলের গোড়ায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছে না। এ থেকেও চুল পড়ে। সৌন্দর্যচর্চার নানা কৃত্রিম পদ্ধতি বেশি ব্যবহারের ফলে চুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বারবার রিবন্ডিং, রঙ করা চুলের ক্ষতির কারণ। পরিবেশ দূষণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ ইত্যাদি পরোক্ষভাবে দ্বায়ী চুল পড়ার জন্য।
খুশকি থেকে মুক্তি :
আমাদের জীবনে খুশকি সমস্যায় অনেকেই ভোগেন। কারণ এটি অতি সাধারণ একটা সমস্যা। মাথার ত্বকে নতুন কোষ তৈরি হয় এবং পুরনো কোষগুলো ঝরে যায়। এটা একটা ক্রম। কিন্তু পুরনো কোষগুলো যখন ঠিকঠাক মতো ঝরে যেতে পারে না তখন সেগুলো জমে যায় এবং ফাঙ্গাস সংক্রমিত হয়। ফলে খুশকি হয়। মাথা থেকে সাদা গুঁড়ার মতো খুশকি পড়ে এবং মাথা চুলকায়। মাথায় খুশকির সৃষ্টি নানা ভাবে হতে পারে। মাথার ত্বক যদি অতিরিক্ত তৈলাক্ত হয়, যদি চুল নিয়মিত পরিষ্কার না করা হয় তাহলে সহজেই খুশকি হয়। স্কাল্প বা মাথার ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হলেও খুশকি হতে পারে। এমনি মানসিক দুশ্চিন্তার কারণেও খুশকি হয়। শীতকালে আবহাওয়া থাকে শুষ্ক ও ধুলাবালিযুক্ত। ফলে খুশকির প্রকোপও বেড়ে যায়। যাদের খুশকির সমস্যা অন্যান্য সময় থাকে না, দেখা যায় শীতকালে তাদেরও খুশকির সমস্যা হয়। খুশকি কোনো রোগ বা রোগের লক্ষণ নয়। তবে চুল ও মাথার ত্বকের সামান্য যত্ন নিলেই এই সমস্যা দূর করা সম্ভব। নিজের চিরুনি, ব্রাশ, তোয়ালে, বালিশের কভার যথাসাধ্য পরিষ্কার এবং আলাদা রাখতে হবে। তাতেই খুশকি অনেক কমে যাবে। জেনে নিন ছেলেদের চুলের যত্নে দারুণ উপকারী হেয়ার প্যাক-
(১) পুরনো তেঁতুল পানিতে গুলে নিয়ে। গোলানো তেঁতুল চুলের গোঁড়ায় ভালো করে লাগাতে হবে। এরপর ১০-১২ মিনিট অপেক্ষা করে চুল শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলতে হবে। সপ্তাহে অন্তত ২ দিন তেঁতুল মাথায় দিলে। এতে খুশকি যেমন দূর হবে তেমনি মাথার চুলকানিও কমে যাবে।
(২) টকদই খুশকি দূর করতে ও চুল ঝলমলে করতে খুবই কার্যকরী। ৬ টেবিল চামচ টকদই খুব ভালো করে ফাটিয়ে নিয়ে। এরপর এতে ১ টেবিল চামচ মেহেদি বাটা ভালোভাবে মেশাতে হবে। মিশ্রণটি চুলের গোড়াসহ পুরো চুলে লাগিয়ে ৩০-৪০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এরপর চুল ভালো করে শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। সপ্তাহে একদিন এই মিশ্রণটি ব্যবহার করলে। এতে চুল যেমন খুশকিমুক্ত হবে তেমনি চুল হয়ে উঠবে ঝলমলে ও রেশমি।
(৩) একটি ডিমের সাদা অংশ ও ৪ টেবিল চামচ টকদই খুব ভালোভাবে ফাটিয়ে নিয়ে। এরপর এতে ১ টেবিল চামচ পাতিলেবুর রস মিশিয়ে। মিশ্রণটি মাথার ত্বকসহ পুরো চুলে লাগাতে হবে। ২০ মিনিট পর চুল শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলতে হবে। সপ্তাহে অন্তত ১ বার এটা ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে।
(৪) মেথি চুলের খুবই উপকারী একটা উপাদান। নারকেল তেল গরম করে নিয়ে। এরপর এতে মেথি গুঁড়া মিশিয়ে। মিশ্রণটি পুরো চুলে লাগিয়ে ১ ঘণ্টার পর শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলতে হবে। দ্রুত ফল পাওয়ার জন্য সপ্তাহে ৩ দিন এটি ব্যবহার করতে হবে।
(৫) মেথি সারা রাত ভিজিয়ে রেখে। তারপর এটি থেঁতো করে চুলের গোড়ায় লাগাতে হবে। ৩০ মিনিট পর চুল ধুয়ে ফেললে ভাল হবে। সপ্তাহে অন্তত দুবার মেথি লাগাতে হবে।
(৬) চুলের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ও খুশকি দূর করতে অলিভ অয়েলের জুড়ি নেই। অলিভ অয়েল গরম করে নিয়ে। এতে পাতিলেবুর রস মিশিয়ে। চুলের গোড়াসহ পুরো চুলে লাগিয়ে ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করে। এরপর চুল ভালো করে শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলতে হবে। সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার চুলে অলিভ অয়েল লাগাতে হবে। খুশকি দূর হবে সাথে চুল হবে কোমল ও ঝলমলে। একই পদ্ধতিতে নারকেল তেলও ব্যবহার করতে পারেন।
(৭) পেঁয়াজের রস খুব দ্রুত খুশকি দূর করতে পারে। পেঁয়াজ মিহি করে বেটে নিয়ে রস ছেঁকে নিয়ে। পেঁয়াজের রস চুলের গোড়ায় ভালো করে ঘষে ঘষে লাগাতে হবে। এরপর ২০-২৫ মিনিট রেখে চুল ভালোভাবে শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলতে হবে। সপ্তাহে অন্তত দুবার মাথায় পেঁয়াজের রস লাগাতে হবে। এতে মাথা চুলকানোও কমে যাবে।
(৮) একটি পাকা কলার পেস্ট, ১ টেবিল চামচ মধু, ১ টেবিল চামচ লেবুর রস দিয়ে একটি প্যাক তৈরি করে। প্যাকটি ভালভাবে মাথায় লাগাতে হবে। শুকিয়ে গেলে শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলতে হবে। বাইরে ঘোরাঘুরির কারণে ছেলেদের চুল খুব রুক্ষ হয়ে যায়। চুলের রুক্ষতা দূর করতেও এই প্যাক অনেক বেশী কার্যকরী।
(৯) মেহেদির সাথে আমলকীর গুঁড়া, ২ টেবিল চামচ দুধ দিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিয়ে। ১ ঘণ্টার পর শুকিয়ে গেলে শ্যাম্পু করে ফেলতে হবে। বাইরের ক্রেমিক্যাল পণ্য দিয়ে চুল রং না করে মেহেদি ব্যবহার করা অনেক বেশী নিরাপদ। এটা চুলের গোঁড়াকে মজবুতও করে।
ছেলেদের চুলের যত্নে ৫ টি গুরত্বপূর্ণ পরামর্শ :
ভাল একটি শ্যাম্পু বেছে নিতে হবে : বাজারে ছেলেদের চুলের উপযোগী বিভিন্ন শ্যাম্পু পাওয়া যায়। কিন্তু সপ্তাহে কয়দিন শ্যাম্পু করতে হবে, চুলের ধরণের সাথে মিলিয়ে কি ধরণের শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে এই ব্যাপারগুলো অনেকেই জানে না। উলটো অনেকে আজেবাজে কিংবা চুলের সাথে সামঞ্জস্যহীন ব্র্যান্ড ব্যবহার করার কারণে চুলের আরো ক্ষতি করে ফেলে। তাই নিজের চুলের ধরণের সাথে মিলিয়ে ভাল একটি শ্যাম্পু বেছে নিতে হবে।
শ্যাম্পুর পরে কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে : শ্যাম্পু করার পর কন্ডিশনার ব্যবহারে চুল ঝরঝরে হয়ে ওঠে। তাই শ্যাম্পু করার পর কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে। কন্ডিশনার এর স্থলে এক মগ পানিতে লেবুর রস দিয়েও চুল ধুয়ে নিতে পারেন। কন্ডিশনার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কন্ডিশনার যেন চুলের গোড়া ও মাথার ত্বকে না লেগে থাকে সেটাও খেয়াল রাখবেন।
মাথার ত্বক ম্যাসাজ করা দরকার : মাথায় তেল লাগানোর সময় বা শ্যাম্পু করার সময় আঙ্গুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ম্যসাজ করতে হবে। এতে মাথার ত্বকের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া দিনে কয়েকবার মোটা দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াবেন।
জেল, হেয়ার স্প্রে দিয়ে অনেকক্ষণ রাখা যাবে না : ছেলেরা বেশিরভাগ সময় যে ভুলটি করে থাকে, তা হল চুলে অনেক সময় ধরে জেল হেয়ার স্প্রে ব্যবহার করে। এতে সহজেই চুলে ময়লা ধুলোবালি আটকে যায়। এছাড়া লম্বা সময় ধরে জেল ব্যবহার করলে মাথার ত্বকের সমস্যা হতে পারে। তাই দিনের বেলা যখন আপনার বাইরে কাজ করার সম্ভাবনা বেশি তখন জেল ব্যবহার করবেন না। আর যখনই জেল বা হেয়ার স্প্রে ব্যবহার করবেন চেষ্টা করবেন দ্রুত বাসায় ফিরে চুল ধুয়ে ফেলতে।
অন্যান্য : প্রচুর পানি পান করতে হবে হবে, চা-কফি, ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। সেলুনে অনেকে চুল কাটার পর জোরে জোরে মাথা ম্যাসেজ করিয়ে নেয়। এতে চুলের প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। এইসব করা যাবে না। আর পাঁচ মিনিটে করা যায় এরকম একটি চুলের ফ্যাশন বা স্টাইল বেছে নিতে হবে।
যে বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে :
(১) নিয়মিত চুল আঁচড়াতে হবে। এতে খুশকি হবার সম্ভাবনা কমে যাবে।
(২) পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন। এতে মাথার ত্বক ও চুল ভালো থাকবে।
(৩) চুল নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার। কারণ অপরিচ্ছন্ন চুলে খুশকি হয় বেশি।
(৪) কিছু চর্মরোগ সাধারণভাবে দেখতে খুশকির মতো হয়। তাই মাথায় খুশকির পরিমাণ বেশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
তথ্য এবং ছবি : গুগল