পোশাকের শালীনতা, স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচার।
- ফারজানা আক্তার
- সেপ্টেম্বর ১১, ২০২২
গত কয়েকদিন ধরে পোশাক নিয়ে আবার বেশ আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে। গত ১৬ আগস্ট একটি মামলার পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত পোশাকের স্বাধীনতার নাম দিয়ে যারা পশ্চিমা অপসংস্কৃতি আমদানি করছে, তাদের বিরুদ্ধে বলেছেন। এই নিয়ে আবার শুরু হয়েছে আলোচনা, সমালোচনার ঝড়।
একদল আন্দোলন করছে পোশাকের শালীনতা নিয়ে, অন্যদল পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই শালীনতার এবং স্বাধীনতার মাপকাঠি কতটুকু অথবা সংজ্ঞা কী?
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে যতগুলো আন্দোলনের ছবি দেখছি তাদের মধ্যে যারা পোশাকের শালীনতার প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে আন্দোলন করছেন তারা সবাই বোরখা পরে আছেন, আর যারা পোশাকের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন করছেন তাদের কয়েকজন আবার ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরে অংশগ্রহণ করেছেন।
আরো পড়ুন: নিজের সম্পর্কে জানতে চান ? এই কৌশলটি অনুসরণ করুন।
বোরখা মানেই শালীনতা আর ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরা মানেই স্বাধীনতা; এই মাপকাঠি ওরা কোথায় পেলো? কে দিলো? আইনের কততম ধারাতে এর মাপকাঠি পাশ হলো?
সময়ের সাথে সাথে অনেককিছুর পরিবর্তন হয়। একইসাথে সামাজিকতা এবং সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আসে। এটা খারাপ কিছু নয়। পোশাক আমাদের ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য, সভ্যতা এবং লজ্জাশীলতার পরিচয় বহন করে। যে কোন পোশাককেই যদি আপনি সঠিকভাবে ক্যারি করতে পারেন সেটাতেই আপনি দারুণভাবে মানিয়ে যাবেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে শালীনতার সংজ্ঞা হচ্ছে যেটা আমার চোখে আরামদায়ক। এখন সেটা হিজাব, বোরখাও হতে পারে, আবার জিন্স, টপসও হতে পারে। আমি অনেক বোরখা এবং হিজাব পরা নারীদের দেখেছি তারা এমনভাবে পোশাকটি পরিধান করেছেন পুরো চোখে লেগেছে। কিছু মানুষ পোশাকের শালীনতা বলতে যা বোঝেন, সেই বোরখা এবং হিজাব পরেও সেই শালীনতা বজায় রাখতে পারেন না। অন্যদিকে এমন অনেক নারীকে দেখেছি যারা টপস, জিন্স, টি-শার্ট পরেছেন; মোটেও অস্বাভাবিক লাগছিলো না। উল্টো মনে হয়েছে ওই পোশাকটি তাদের জন্যই বানানো হয়েছে।
আরো পড়ুন: আপনি একজন এমপ্যাথিযুক্ত মানুষ, নাকি এমপ্যাথিবিহীন ?
এখন আপনি ধর্মীয় ব্যাপারে বলতে পারেন মানে যেহেতু আমি মুসলিম আমাদের ধর্মে পোশাক নিয়ে নির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, বোরখা পরতে হবে এমন কোনো নির্দেশনা নেই। নির্দিষ্ট কিছু অংশ বাদে শরীর ঢেকে রাখতে হবে, এমন আঁটসাঁট পোশাক পরা যাবে না, যাতে অঙ্গগুলোর অবয়ব ফুটে ওঠে। বোরখা ছাড়া অন্য পোশাকেও এই শর্ত পূরণ করা যায়। ইসলামে এটাই শালীনতা।
এখন বিষয় হচ্ছে, আমরা সবাই প্রাক্টিসিং মুসলিম না, আমাদের রাষ্ট্রীয় আইন ও সামাজিক সংস্কৃতি অনুযায়ী জোর করে ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে অমুসলিম কিংবা নন-প্রাক্টিসিং মুসলিম মানুষেরা তাদের উপযোগী পছন্দমতো পোশাক পরতেই পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ নিজের পছন্দ এবং অপছন্দকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের সেই মুসকানের কথা মনে আছে? বোরখা এবং হিজাব পরে স্কুটি চালিয়ে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতেই হেনস্তার মুখে পড়ে। প্রতিবাদ হিসেবে তখন সে জোরে 'আল্লাহু আকবর' বলে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যায়।
আরো পড়ুন: আপনার মন আপনাকে কন্ট্রোল করে, নাকি আপনি মনকে ?
তখন সবাই মুসকানের প্রশংসা করেছিলাম এবং সাপোর্ট জানিয়েছিলাম। একইসাথে বলেছিলাম সবারই নিজেদের পছন্দের পোশাক পরার স্বাধীনতা আছে। মুসকানদের যদি বোরখা এবং হিজাব পরার স্বাধীনতা থাকে, অন্যরা যারা জিন্স /টপস, টি - শার্ট যার যা খুশী ইচ্ছে পরার স্বাধীনতাও থাকা উচিত, তাই না ?
এবং এই স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। প্রতিটি দেশের, সমাজের কিছু নিজস্বতা রয়েছে। নিজেদের সংস্কৃতি রয়েছে। পোশাকের স্বাধীনতা অবশ্যই রয়েছে এবং থাকা উচিত; কিন্তু এই স্বাধীনতার নামে আপনি স্বেচ্ছাচারিতা করতে পারেন না।
এখন কতুটুকু স্বাধীনতা এবং কতটুকু স্বেচ্ছাচারিতা সেটা আপনি যে সমাজে বসবাস করেন, যে সংস্কৃতি আপনি ক্যারি করেন সেই অনুযায়ী বুঝে নিতে হবে। সেটা আপনাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দেওয়া বা বলা সম্ভব নয়।
আরো পড়ুন: জীবনের খারাপ সময় কাটিয়ে উঠতে এই ৭টি কথা অবশ্যই মনে রাখবেন
ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই। হিরো আলম যখন একের পর এক আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত উপহার দিচ্ছিলেন তখন আমরা সবাই বিরক্ত হচ্ছিলাম। তাকে নিয়ে নানান কথা বলছিলাম। তার এক্টিভিটি নেগেটিভ প্রভাব ফেলছিলো আমাদের সংস্কৃতির উপর। হিরো আলমের কিন্তু স্বাধীনতা রয়েছে রবীন্দ্র, নজরুল, আধুনিক, ফোক যা ইচ্ছে গাওয়ার, কিন্তু তবুও আমরা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলাম। কিন্তু কেন? কারণ তার এই এক্টিভিটি নেগেটিভ প্রভাব ফেলছিলো। কিন্তু হিরো আলমের কর্মকাণ্ড আইনগত কোনো অপরাধ নয়, তাকে থামিয়ে দেওয়া যায় না, কিন্তু সমালোচনা করতে পারি। আমরা যদি স্বাধীনতার নাম করে স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রমোট করি আমাদের ভবিষৎ তো এমনি অন্ধকার। অদূর ভবিষতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম আলোর দেখা কখনোই পাবে না।
সবথেকে বড় যে ব্যাপার; আমার একইসাথে হাসি পাচ্ছে এবং আফসোসও হচ্ছে। এটা ২০২২ সাল। তাও প্রায় শেষ। অন্য দেশের নারীরা যেখানে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অবদান রাখছে। কতশত অর্জন, মেডেল জিতে নিচ্ছে। নানান কাজে নিজেদের দক্ষতার জন্য ইতিহাসে নাম লেখাচ্ছে; সেখানে আমার দেশের নারীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এক দল বোরখা পরানোর জন্য আন্দোলন করছেন, অন্য দল ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরে আন্দোলন করছেন।
আরো পড়ুন: অপরিচিত মানুষদের সাথে সহজে মেশার উপায় কী ?
আমাদের দেশের নারীরা এখনো অনেকদিক থেকে পিছিয়ে আছে। নারীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, জেনেছি এবং নিজে ফেস করছি এখনো আমাদের কতশত পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। কিন্তু এরা আন্দোলন করছে পোশাক নিয়ে। আমাদের দেশে এখনো কোনো পোশাক নিষিদ্ধ হয়নি যে সেটা নিয়ে আন্দোলন করতে রাস্তায় নামতে হবে। আন্দোলন করার মতো অনেক ইস্যু রয়েছে। সেসব নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই।
এসব হাস্যকর দুই একটি আন্দোলন করে নারীদের আরো হাস্যকর করে তুলে ধরা হচ্ছে। যে সব বিষয় নিয়ে আমাদের কথা বলা প্রয়োজন সেইসব নিয়ে কথা বলতে আজকাল বিব্রতবোধ করি; কারণ ওই যে প্রয়োজনীয় কথা বলতে গেলে মানুষজন এইসব হাস্যকর বিষয় নিয়ে টিটকারি মারে।
সেই যে আমাদের দেশে একবার বেগম রোকেয়া এসেছিলেন; তারপর থেকে যারাই নারীদের জন্য আন্দোলন করতে এসেছেন তারা সেই পিরিয়ড এবং পোশাকেই আটকে রইলেন।
একটি দীর্ঘশ্বাস আমার নিজের জন্যও এবং আমার দেশের সকল নারীর জন্যও।
আরো পড়ুন: মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার কার্যকরী কিছু পদ্ধতি