ডাক্তার আবার লেখক হয় নাকি !
- নাসিমন নাহার
- ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮
মেয়েদের আসলে দোষের শেষ নেই এই দেশে ! তার উপরে সে যদি হয় ডাক্তার তাহলে তো কথাই নেই। এই যে আমি ডাক্তারী করেও লেখালেখি শুরু করার সাহস করেছি আমাকেও লোকের কথা শুনতে হচ্ছে। কি কি শুনছি আমি জানেন ?
#তসলিমা নাসরিন হবা ? অথচ কেউ বলল না বেগম রোকেয়া হবা? আসলে তো তারা পড়েই নাই রোকেয়ার লেখা।বলবে কিভাবে? তীব্র ঙ্গানের সংকট।
#মেয়ে মানুষ তো সিম্প্যাথি নিয়ে এগুচ্ছে। হাহাহা সিম্প্যাথি সীকার আমি কখনোই না।তাহলে ঢাকার শহরের লোভনীয় পস চাকরি ফেলে বন জঙ্গলে মানবসেবার কাজ করতাম না।আমি নিজেই এই সমাজ থেকে দূরে থাকতে চাই।
#ডাক্তারীতে ভাত নাই তাই লেখালেখি করছে। ও হ্যালো ডাক্তারী করেই পায়ের নীচের মাটি শক্ত করে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি।লেখালেখির সাহস করেছি।
#যেহেতু মেয়ে সেহেতু..........a....নোংরা কিছু শব্দ। হুমমম যখন একজন মেয়ে একেবারে একা নিজের চেষ্টায় কোন রকম রাজনৈতিক এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজের ব্যবহার ছাড়া ঝড় ঝাপটা মারিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে তখন আমাদের so called সোসাইটি শেষ অস্ত্র হিসেবে চরিত্র ধরে কথা বলে মেয়েটাকে কুপোকাত করতে চায়।এটা আমি খুব ভালো করেই জানি।আর তাই আমি নিজেকে বলি-- মিম্ মি চপেটাঘাত সঠিকভাবে হচ্ছে।আর পেছনে ফিরে দেখার সময় নেই।চোখ আর পা শুধু সামনেই চলবে নর্দমার কীটদের দলাই মলাই করে, মুখ বন্ধ করে। যাহোক আজ আমার কথা বলার জন্য লিখছি না।লিখছি মেডিকেলের মেয়েদেরকে নিয়ে।
মেডিকেলে পড়বা?ডাক্তার হবা? --- নামের আগে ট্যাগ পাইবা "মেডিকেলের মাইয়া"।যেন মেডিকেলের মেয়েগুলো.....হয়।শব্দগুলো আর না বলি। জানেন তো ,মেডিকেলের মেয়েরা তো আসলে ভালো হয় না ! একেবারে প্রথম বর্ষে ই সারাদিন এনাটমী ল্যাবে বডি ঘাটাঘাটি করি আমরা।ফরমালিনে ডুবানো মানুষের দেহের এক একটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, হাড়, মাংস, নার্ভ, চামড়া আমরা খালি হাতে ধরে ধরে পড়ি, শিখি, জানি--- মানবদেহের কলকব্জা।'হিউম্যান বডি' আমাদের বই খাতা।বডি ছেলে না মেয়ে তা ভাবার সুযোগ নেই আমাদের।ঠিক তেমনি আমার পাশে বসে বডি দেখা, পড়া সমবয়সী ছেলে/মেয়েটি আমার আইটেম পার্টনার, ব্যাচমেট, সে ছেলে না মেয়ে এটা মাথায় ঢুকানোর সুযোগ নেই।
----অনুভূতি লুকিয়ে রক্ত মাংসের মানুষ হবার পাঠের শুরুটা মূলতঃ এই এনাটমী ডিসেকশন হল থেকেই আমাদের। এনাটমী ক্লাসে আমাদের hand gloves পরার অনুমতি ছিল না। ফরমালিনের ঝাঁঝে চোখের জলে ভেসে, হাতের তালুর চামড়া কুঁচকে মানব শরীর শিখি আমরা।প্রথম প্রথম একা একা এনাটমী করিডরে যেতেও ভয় লাগতো।মনে হতো লোহার বক্সে ফরমালিনে ডুবানো সংরক্ষিত ডেডবডিটা যদি উঠে বসে ! Honestly আমার এই অনুভূতি টা হতো।আবার স্যার/ ম্যাম যখন কাঠি দিয়ে মাসলগুলো, নার্ভগুলো চেনাতো সত্যি সত্যিই কান্না পেত আমার।আহারে বডিটা না জানি কার? একদিন সে আমার মতো মানুষ ছিল।তার জীবনেও না জানি কত গল্প ছিল।চিরকাল জীবনের গল্প খোঁজা মানুষ আমি।মনে মনে কথা বলতাম বডির সাথে-- "আসসালামু আলাইকুম মা।শরীরটা ভালো ?বাড়ী কই গো মা আপনার?"
---- মেডিকেল কলেজ আমাকে শিখিয়েছে রোগী কে মা/ বাবা বলে সম্বোধন করতে।রক্তে মিশে গেছে এটা।নিজের থেকে কম বয়সী রোগীকেও মা বা বাবা বলেই ডাকি।যতদিন ডাক্তারী পেশাতে আছি ততদিন বদলে যাবে না এই ডাক।যেদিন বাই বলব ডাক্তারী পেশাকে সেদিন হয়তো আপনাদের মতো করে আমিও বলব ঐ যে 'মেডিকেলের ছেলে/ মেয়ে' ! (আজকাল খুব মনে হয় আমি ফীট না এই প্রফেশনের জন্য এই দেশে, এই সমাজে) এর পর তৃতীয় চতুর্থ বর্ষে আমরা পড়ি ফরেনসিক মেডিসিন। লাশ কাটাকাটি দেখার শুরু।লাশ কাটা ঘরে প্রথম যেদিন পা রাখি সেখানে আগরবাতি জ্বলছিল। আগরবাতির গন্ধ এখনো আমার বুকে কাঁপন ধরায়।দোকানে বা কারো বাসায় ধূপকাঠি বা আগরবাতি গন্ধ নাকে এলে আমি এলোমেলো হতে শুরু করি।মনে পড়ে যায় লাল ডুরে শাড়ি পরা কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করা কিশোরী মেয়েটির কথা।চোখের সামনে দেখলাম স্যারের instructionsএ ডোম মামা কিভাবে একজন মানুষের শরীরের এক একটা অংশ আলাদা করে ফেলল।তাজা রক্তের ঘ্রান কত বিভৎস।জানেন আজ এতগুলো বছর পরেও সেদিনের কথা লিখতে চোখে জল ভরে এল।ঐদিন ক্লাস শেষে রুমে ফিরে থম মেরে বসে ছিলাম পুরো হোস্টেলের সব ক্লাসমেটরা।অনেকেই ঐদিন লাঞ্চ স্কীপ করেছিলাম।রাতে ঘুমোতে পারিনি অনেকেই।
------সেই প্রথম আমাদের খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে কেস নিয়ে ভাবা, মন খারাপ লুকিয়ে গম্ভীর হবার মুখোশ আটা মুখে, আজীবনের জন্য এসিডিটি, ইনসোমনিয়ার সাথে বসবাসের শুরু আমাদের। এরপর সার্জারি, মেডিসিন, গাইনী শেখা, পড়া, জানা আমাদের হাতেকলমে।কখনো পৃথিবীতে মানব শিশুর আগমনের ,কখনোবা মানুষের জীবনের শেষ নিঃশ্বাসের সাক্ষী আমরা। জীবনের আনন্দ দুঃখগুলোকে আর কেইবা কবে ছুঁয়ে দিয়েছে আমাদের মতো করে ?
কিন্তু দিনশেষে আমরাও রক্ত মাংসের মানুষ, এঞ্জেল বা ডেভিল না,ভুল আমাদেরও হতে পারে।কিন্তু কথায় কথায় আমাদেরকে হেনস্থা করা,বুলি করা, শুধুমাত্র নারী বলেই সোস্যাল মিডিয়াতে বডি শেমিং করাসহ যাবতীয় নোংরামো যারা করছে তারা কি আদৌ সুস্থ মানসিক ভাবে? মানসিক বিকৃতি এক ধরনের অসুস্থতা।যথা সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না গেলে রোগী এবং তার পরিবার এবং আশেপাশের মানুষজন বিপদে পড়বে।আবার আমাদের আন্ডারেই এডমিশন নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থেকে যেতে হবে। আমাদের তেমন কিছুই হবে না।এসব নেগেটিভ কথা শুনতে শুনতে আমাদের চামড়া দু স্তর পুরু হয়ে যায় ইন্টার্নশীপের সময়েই। এক দিন দুদিন সাতদিন পর এসব গসিপে কান দেবার সময় কারো থাকবে না।নতুন ইস্যু নিয়ে মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়বে।মাঝখান থেকে কেঁচো খুঁড়তে যেয়ে সাপ বের হবার মতো কে কবে কোন মামলার আসামী ছিল ইত্যাদি ধামাচাপা দেয়া ক্রাইম প্রকাশ হয়ে যাবে।যা থেকে আমার মতো সামান্য চিকিৎসক এবং অ-লেখক থ্রিলার লেখার
ভাবনা চিন্তা শুরু করবে। সুতরাং ভাবিয়া করিও ট্রল, ভাবিয়া লাগিও পিছু চিকিৎসকের, দিনশেষে নিজের সন্তানকে কসাই বানাতে এই তোমরাই ছুটবা মেডিকেল কলেজের দ্বারে।