আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কেমন হওয়া উচিত
- ফারজানা আক্তার
- আগস্ট ২৪, ২০২৩
মাঝে মাঝে আমি আমার বন্ধু - বান্ধব, পরিবারের সদস্য, শুভাকাঙ্খী কিংবা যে কোনো গল্প, আড্ডা এবং আলোচনায় যারা থাকেন তাঁদের হুটহাট জিজ্ঞেস করি - তাঁদের জীবনের উদ্দেশ্য কী? আমার এই প্রশ্ন শুনে সবাই একটু চুপ হয়ে যায়। তাঁরা দ্বিধায় পড়ে যায়। একটু ভেবে অনেকে বলে অনেক টাকার মালিক হওয়া, কেউ বলে বাড়ি করা, কেউ বলে দেশের বাইরে সেটেল হওয়া, কেউ বলে ভালো ডাক্তার / ইঞ্জিনিয়ার ( যে যার পেশায় আছে সেখানে বেস্ট হওয়া আরকি!)। আমি তখন পুনরায় জিজ্ঞেস করি ধর্মে বিশ্বাস করো! বেশিরভাগ উত্তর পজেটিভ হয়। তাঁরা ধর্মে বিশ্বাস করে।
এখন আমরা যারা ধর্মে বিশ্বাস করি তাঁরা জানি পরকাল আছে। এবং ইহকালে ভালো - মন্দ যা করেছি পরকালে তাঁর সকল হিসাব নিকাশ দিতে হবে। ভালো কাজের জন্য পুরস্কার দেওয়া হবে, এবং খারাপ কাজের জন্য শাস্তি দেওয়া হবে। ধরে নিচ্ছি আপনি ধর্মে বিশ্বাস করেন। ইহকালে আপনার জীবনের উদ্দেশ্য অনেক টাকার মালিক হওয়া। পরকালের জীবনের জন্য আপনার উদ্দেশ্য কী?
আরো পড়ুন: বিয়ের আগে যে ৪ ভুল করলেই বিপদে পড়বেন
আপনি যে ধর্মেরই হন না কেন পুর্নজন্ম, পুনরুদ্ধার এগুলোতে বিশ্বাস রাখতে হবে। ইহকালে আপনার জীবনের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। মানে আপনি অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। এখন টাকা দিয়ে আপনি বাড়ি, গাড়ি, পছন্দের নারী/পুরুষ সকলকিছু নিয়ে বেশ সুখে শান্তিতে জীবন কাটালেন। একই রকম জীবনযাপন করে কয়েকদিন পর আপনি ক্লান্ত হয়ে যাবেন না?
টাকা হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার মধ্যে টাকা বানানোর তাড়না কাজ করেছে। টাকা হয়ে যাওয়ার পর সেই তাড়না আর নেই। যখন জীবনের কোনো লক্ষ্য থাকে না, উদ্দেশ্য থাকে না; তখন জীবন পানসে হয়ে যায়। জীবনকে অর্থহীন মনে হয়। এইজন্য মানুষ খুব অল্পতে হতাশ হয়ে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথ বেছে নেয়। কোনো একজন মানুষের জীবনে প্রেম এসেছে।
আরো পড়ুন: মানুষ কেন প্রতারণা করে?
খুব সুন্দর প্রেমময় কিছু দিন কাটানোর পর কোনো কারণে সেই প্রেম ভেঙ্গে গেলো। কিছু কিছু প্রেমিক বা প্রেমিকা শুধুমাত্র এই প্রেম ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অথবা কোনো পরীক্ষায় হয়তো কেউ ভালো রেজাল্ট করেনি কিংবা ডাক্তার হতে চেয়েছে কিন্তু মেডিক্যালে চান্স পায়নি অথবা বাবা - মা, ভাই - বোনের সাথে কোনো বিষয়ে মনোমালিন্য হয়েছে; অথবা দীর্ঘদিন ধরে কোনো কারণে হতাশায় ভুগছে - এই কারণগুলোর জন্য আত্মহত্যার পথে হাঁটে অনেকে। এই মানুষগুলোর জীবনে হতাশা ছিলো, ব্যর্থতা ছিলো, না পাওয়া ছিলো, আক্ষেপ ছিলো; শুধু উদ্দেশ্য ছিলো না।
এই মানুষগুলো আত্মকেন্দ্রিক ছিলো। তাঁদের ভাবনার জীবনে শুধুমাত্র তাঁরাই ছিলো। তাই তাঁরা জীবনে যা চেয়েছে সেগুলো পাওয়া হয়নি মানেই তাঁরা ভেবে নিয়েছে তাঁদের জীবনের আয়ু শেষ। তাঁদের বেঁচে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। ইহকাল এবং পরকাল দুই কালই তাঁরা একইসাথে হারিয়ে ফেলে। সবার জীবনে উদ্দেশ্য থাকা উচিত। কার জীবনের উদ্দেশ্য কী হবে সেটা তাঁকেই ঠিক করতে হবে। যাদের জীবনে উদ্দেশ্য থাকে হতাশা কিংবা প্রতিকূলতা তাঁদের কখনো থামাতে পারে না। কারণ যে জীবনের উদ্দেশ্য জানে হতাশা কিংবা দুঃখ - কষ্ট নিয়ে বেশি ভাবার সময় তাঁর নেই।
আরো পড়ুন: জীবনের কঠিন পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করবেন
মানুষের জীবনে দুঃখ - কষ্ট থাকবেই। বিখ্যাত মনীষীদের দিকে তাকান কার জীবন সুখের ছিলো? আমাদের নবী - রাসূল এবং সাহাবীদের দিকে তাকান কাদের জীবন স্বস্তির ছিলো? সবাইকে লড়াই করতে হয়েছে। জীবনের প্রতি ধাপে ধাপে তাঁদের নানান প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে, কিন্তু কেউ হাল ছেড়ে দেয়নি। কারণ সবার জীবনে উদ্দেশ্য ছিলো। একটি নিদির্ষ্ট লক্ষ্য ছিলো। এইলেখা শেষ করার আগে আমি নিজের কিছু কথা বলি।
এতক্ষণ আমি যে কথাগুলো বললাম সেগুলো আমি নিজে বিশ্বাস করি এবং মেনে চলি। আমার জীবনের কয়েকটা বছর আমি মারাত্মক লেভেলের ডিপ্রেশনে ছিলাম। একদম সুইসাইডাল স্টেজে ছিলাম। আমিও ভেবেছিলাম আমার বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই। আমার জীবন অর্থহীন।
যতবার আমি আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছি ততবার আমার চোখে আমার বাবা- মা এবং ভাই - বোনের চেহারা ভেসে উঠেছে। তাঁরা আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি কীভাবে নিজেকে শেষ করে তাঁদের এইভাবে কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবছি? এর সাথে যুক্ত হলো - আমার মনের স্বপ্নগুলো আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শেখালো। আমার মনে হলো আমি জীবনে যা পাইনি সেটা তো পাইনি, কিন্তু পরিবার, সমাজ, দেশ এবং দেশের মানুষকে আমার দেওয়ার অনেককিছু আছে। আমি ডিপ্রেশনে থাকাকালীন আমার মা আল্লাহর মেহমান হয়ে গেলেন।
আরো পড়ুন: ক্ষমা ছাড়া মুভঅন করা সম্ভব
আমার মা শুধু আমার মা ছিলেন না; একইসাথে আমার সবথেকে ভালো বন্ধু, মানসিক শক্তি, অনুপ্রেরণা সকলকিছু ছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর শুরুতে আরো ভেঙ্গে পড়লাম কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হলো আমার মাকে সেইভাবে কিছুই দেওয়া হয়নি। কিন্তু এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। যেহেতু এখনো আমি বেঁচে আছি, সুস্থ আছি তাই মায়ের জন্য কিছু করা দরকার।
অনেকের মনে প্রশ্ন থাকতে পারে - আমার মা আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছেন। এখন মায়ের জন্য কীভাবে কী করবো! তাঁদের জন্য উত্তর - মানুষ তাঁর কর্মের মধ্যে বেঁচে থাকে। আমার মা তাঁর জীবনে খুব অল্প আয়ু পেয়েছেন। এই অল্প আয়ুর মধ্যে তিনি আমাদের তিন ভাই - বোনকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আমার জীবনের সকল ভালো কাজে যতবার আমার নাম আসবে ততবার আমার মায়ের নামটাও যেন উচ্চারিত হয় সেইভাবে আমি কাজ করতে চাই। আমার মাথায় সারাক্ষণ এই ভাবনাটা ঘুরতে থাকে।
এবং আমি সেই লক্ষ্যে কাজ করার চেষ্টা করছি। যতই ডিপ্রেশন কিংবা হতাশা যাই বলি না কেন আমাকে জাপ্টে ধরে, আমার জীবনের এই লক্ষ্যের কারণে ডিপ্রেশন আমাকে কাবু করতে পারে না। কারণ আমার স্কিল বাড়াতে হবে, আমাকে কাজ করতে হবে; দিন রাত গালে হাত দিয়ে বসে বসে কাঁদার কিংবা জোরে জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলার অতো সময় কই? আপনি যত টাকার মালিক কিংবা ক্ষমতাশালীই হন না কেন; আপনি যদি মানুষের জন্য পজেটিভ কোনো কাজ করতে না পারেন - তবে জেনে রাখুন এই দুনিয়ায় আপনার থাকা কিংবা না থাকাতে কারোরই কিছু যায় আসে না।
আরো পড়ুন: যেকোনো পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে শান্ত থাকার উপায়
কিন্তু পরকালে আপনার জবাবদিহি করতে হবে। যেমন আল্লাহ যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে - মিস্টার রহিম কিংবা রহিমা; তোমাকে আমি অনেক টাকা, ক্ষমতা এবং মেধা দিয়েছিলাম। দুনিয়ায় তুমি তোমার স্বজাতির জন্য কী করে আসলে? পরকালে কী উত্তর দিবেন সেই প্রস্তুতি ইহকালে নিতে হবে।
সকলের জন্য অনেক দোয়া এবং ভালোবাসা।