ডিভোর্সের কথা সন্তানকে জানানো কি ঠিক হবে?
- অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
- আগস্ট ২৮, ২০২৪
বিবাহ বিচ্ছেদ বাবা-মা ও সন্তান—উভয়ের জন্যই একটি কঠিনতম প্রক্রিয়া। আপনি যদি স্বামীকে ডিভোর্স দেন, তবে তা অবশ্যই সন্তানকে জানাবেন। আপনার সন্তান যেন মামা–খালা, নানি–দাদি বা বাইরের মানুষের কাছ থেকে ডির্ভোসের কথা না শোনে। কারণ এতে সে নিজেকে অনেক বেশি পরিত্যক্ত ও প্রত্যাখ্যাত বোধ করবে।
বাবা-মায়ের দায়িত্ব ডিভোর্সের ফলে পরবর্তী জীবনে কী কী প্রভাব পড়বে সে বিষয়ে সন্তানদের সচেতন করা। এই বিষয়ে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা খুবই জরুরি। এই আলোচনায় বাবা-মা পরস্পরকে অসম্মান করবে না। প্রচলিত বিবাহ বিচ্ছেদে দেখা যায়, একজন অন্যজনকে চরমভাবে দোষ দিতে থাকে।
সন্তানকে কী জানাবেন?
স্পষ্ট করে বলুন যে, ‘তোমার বাবা-মা আর একসঙ্গে থাকতে পারছে না। কিন্তু তোমাকে সন্তান হিসেবে কখনোই আমি পরিত্যাগ করব না। বড়দের পৃথিবীর হিসাবগুলো আলাদা। তুমি যখন বড় হবে তখন আরো অনেক কিছু বুঝতে পারবে। কিন্তু ভয় পেয়ো না, আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে চলে যাব না।’
এভাবে খোলামেলা আলোচনা হলে, সন্তান অনেকটুকু সাবলীলতার সঙ্গে বাবা–মায়ের ডিভোর্সের ধকলটা সামাল দিতে পারবে। তবে বেদনার ভার কমবে না। মনে রাখবেন, এই ঘটনায় আপনার সন্তান তীব্র ভয় পাবে, তাই তাকে সাহস দিন।
আত্মীয় স্বজনদের একটি প্রবণতা থাকে ‘তোমার বাবা কই? মা কই?’ ইত্যাদি ধরনের প্রশ্ন করার। মুখ আছে তো যা খুশি বলে দেয়। একবারও খেয়াল করা হয় না যে, এই কথাগুলো শিশু মনে কতটা বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে।
সন্তানদের বাবা-মা উভয়ের কাছ থেকে আশ্বস্ত হওয়া প্রয়োজন যে, বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও সন্তান হিসেবে তার ভবিষ্যৎ জীবন নিরাপদ এবং সুরক্ষিত থাকবে। সন্তান বাবা-মা উভয়ের মনোযোগ, ভালোবাসা, স্নেহ ও যত্ন পাবে। এ ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় যেন নেওয়া না হয়। কারণ বাবা-মা যখন মিথ্যা বলে, সেটা কোনোভাবেই সন্তান নিতে পারে না। তারা প্রচণ্ড কষ্ট পেয়ে থাকে।
উপরন্তু সন্তান ভাবতে থাকে, তাদের দোষেই বাবা–মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদটা ঘটছে। কারণ সন্তানদের কাছে বড়দের মতো পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না। সন্তানেরা সীমিত তথ্য দিয়ে দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। বাবা–মায়ের মধ্যে অহরহ এ ধরনের কথা প্রচলিত যে, শুধু সন্তানের জন্য সংসার করছে। তা না হলে ডিভোর্স দিয়ে দিতাম। তাই অনেক সন্তান মনে করে, বাবা-মায়ের যন্ত্রণার কারণ তারাই।
আরো পড়ুন:
স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার পর ভুলেও যে ৬টি কাজ করবেন না
স্বামী-স্ত্রী একই অফিসে? যেসব বিষয় মেনে চলবেন
নতুন সংসারে মানিয়ে নেয়ার ১০টি উপায় জেনে নিন
এই ৫ কথা প্রকাশ্যে না বলাই ভালো
সন্তানের জন্য কেমন পরিবেশ দরকার
মনে রাখতে হবে বাবা-মার দ্বন্দ্ব, ঝগড়া সন্তানদের মধ্যে স্ট্রেস তৈরি করে। কাজেই বাবা-মার একজন আরেকজনকে দেখে নেওয়া অথবা টাকা-পয়সার গরম দেখানো, ইগো বাদ দিয়ে খেয়াল করা দরকার সন্তানের কীসে মঙ্গল হয়। বাবা–মায়ের তীব্র দ্বন্দ্ব সন্তানদের ঠেলে দেয় কোনো একজনের পক্ষ নিতে। যেটা অস্বাস্থ্যকর। সবার সামনে সন্তানকে জিজ্ঞেস করা, তুমি কার সঙ্গে থাকবে। এই কথা সন্তানের জন্য মোটেও সুখকর বিষয় না।
বাবা-মায়ের একজন আরেকজনের সম্পর্কে নেতিবাচক কথা সাংঘাতিকভাবে সন্তানের মনোজগতে সমস্যা তৈরি করে। ফলে এই সন্তান না মা’কে সম্মান করতে শেখে, না বাবা’কে। কিন্তু নিজেদেরকে জব্দ করার নেশায় মত্ত বাবা-মা এই জিনিসগুলো ভয়ংকরভাবে অস্বীকার করেন। বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী স্বামী–স্ত্রী সন্তানকে একে অন্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। যারা এমন করছেন, তাদের জন্য অশনি সংকেত। কারণ আজকে জীবনসঙ্গীকে তথাকথিত ‘টাইট’ দিতে যে সন্তানকে ব্যবহার করছেন, কালকে এই সন্তানই আপনাকে টাইট দেবেন। মনে রাখবেন এভাবে আপনি আপনার সন্তানের মনোজগত কলুষিত করছেন।
কে ভালো? বাবা না মা?
সন্তানেরা চায় বাবা-মা দুইজনেই একসঙ্গে থাকুক। এর ফলে তারা একত্রে দুইজনকে পাবে। বাবা-মায়ের দুই জায়গায় থাকাটা সন্তানকে বিষণ্ণ করে। বিশেষ করে সন্তান যখন বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছায়। যদি ডিভোর্সের পরে বাবা-মা দুইজন অনেক দূরে দূরে থাকেন, তবে দুজনেরই দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানের সঙ্গে নিয়মিত ফোন, চিঠি, ই-মেইল ইত্যাদি উপায়ে যোগাযোগ রক্ষা করা। যাতে সন্তান মনে না করে, বাবা-মা তাদেরকে ছেড়ে দূরে চলে গেছে।
ডিভোর্সের পর সন্তানকে কীভাবে সামলাবেন?
সন্তানকে কিছু নিয়মকানুন, নিয়মিত রুটিন এবং নির্দিষ্ট কিছু শর্ত মানাটা শেখানো জরুরি। পুরোটা মায়ের অথবা পুরোটা বাবার ঘাড়ে দেওয়াটা মোটেও সমীচীন নয়। সন্তানের কাজ, স্কুলের ব্যালেন্স টিচার মিটিং এ যাওয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, দাওয়াত, আত্মীয় কুটুম্বিতা ইত্যাদি ভাগ করে নেওয়া জরুরি। বাবা মা দুজনই যখন এই কাজগুলো সমানভাবে ভাগ করে নিবেন তখন সে সন্তান কিন্তু অতটা খারাপ বোধ করবে না।
আমাদের দেশে অধিকাংশ সময় সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব ডিভোর্সের পর মায়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এসব পরিবারে সন্তানেরা যখন সামান্য বেচাল করে, তখন সমাজ হা করে আঙুল তোলে ব্রোকেন ফ্যামিলির দিকে। তখন তারা বলে, ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানেরা ভালো হয় না। মানুষকে যেমন রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ, পরিবার অধিকার দিয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের। ঠিক সেরকমই নিজেদের বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে সন্তানের জীবনে বিষাক্ততা ছড়ানোর কোন অধিকার তাদের দেওয়া হয়নি। কাজেই যারা আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন এই বিষয়টি খেয়াল রাখবেন।
দুটি মানুষ স্বেচ্ছায় একসাথে থাকতে পারছেন না ঠিক আছে, কিন্তু তার মাশুল সন্তানকে কেন দিতে হবে? মুনীর চৌধুরী চমৎকার বলেছেন, ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে-অকারণে বদলায়।’ যেইসব দম্পতি নিজেদের বিবাহ বিচ্ছেদ সত্ত্বেও চমৎকারভাবে সন্তানকে গড়ে তুলছেন স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে, সম্মানের সঙ্গে, তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
লেখক: চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার