গরীবের বৃদ্ধাশ্রম আজ ধনীতে ভরা! 

  • ফারজানা আক্তার 
  • মে ২০, ২০১৮

বৃদ্ধাশ্রম যার অর্থ হলো বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল। সাধারণত বৃদ্ধাশ্রমের জন্ম হয়েছিলো গরীব এবং অসহায় বৃদ্ধদের কথা চিন্তা করে। গরীব মানুষজন এমনিই গরীব, তার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দ্রব্যমূলের উদ্ধগতি, রাজনৈতিক কারণসহ আরো নানা কিছু রয়েছে। তারা নিজের এবং বউ - বাচ্চার ভরণ পোষণই ঠিকভাবে করতে পারে না, সেইজন্য তারা তাদের বৃদ্ধ বাবা - মা'কে অনেকটা বোঝা মনে করে। বাস্তবিক আরো নানা কারণ চিন্তা ভাবনা করেই গরীব এবং অসহায় মানুষদের জন্য তৈরী করা হয় বৃদ্ধাশ্রম। 

আপনি যদি বর্তমান প্রেক্ষাপট একটু দেখেন তাহলে বুঝবেন, গরীবদের জন্য তৈরি করা সেই বৃদ্ধাশ্রম এখন বড়লোকের বাবা মায়ে পরিপূর্ন। অনেকটা হাস্যকর হলেও এই কথাটা সত্যি যে ধনীদের বাবা মায়ের ভিড়ে গরীব বাবা মায়েরা এখন বৃদ্ধাশ্রমেও আশ্রয় পাচ্ছে না। গরীবদের জন্য খোলা বৃদ্ধাশ্রমে ধনীরা কেন? 

রত্না বেগম ( ছদ্মনাম ) কলেজে অংক পড়াতেন। কলেজে খুব সুনাম ছিলো তার। ছাত্র ছাত্রীদের অংকের শিক্ষা ঠিকঠাক দিলেও নিজের জীবনের অংকে বিশাল ভুল করে ফেলেছেন। রত্নার স্বামী ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী। হার্ট এটাকে অল্প বয়সেই মারা যান রত্নার স্বামী।  এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে রত্নার শুরু হয় অল্প বয়সেই বিধবার জীবন। ছেলে মেয়ের কথা চিন্তা করে আবার বিয়ের করেন নি। একদিকে স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসা, সংসার এবং নিজের চাকরি তার একার পক্ষে সামলিয়ে উঠা সম্ভব হয় নি। নিজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের সংসার আর স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসা দেখাশোনা করতে লাগলেন।  মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকে মানুষ করে বিয়ে দিয়েছেন।

রত্না বেগম ভাবলেন এবার একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। রত্না বেগমের ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ে এবং মেয়ের জামাইও তাই মনে করেন। রত্না বেগমের এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। তবে রত্না বেগমের সাথে তার চিন্তার একটু পার্থ্যক রয়েছে। রত্না বেগম ভেবেছেন নিজের বাসায় বিশ্রাম করবেন আর তার ছেলে মেয়েরা ভেবেছেন রত্না বেগম বৃদ্ধাশ্রমে বিশ্রাম করবেন।  রত্না বেগমের ছেলে মেয়ে তাদের পৈতৃক ব্যবসা বাদ দিয়ে সেই মূলধন দিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু করেছে। ভাই বোন একসাথে মিলে বাপের বাড়ি বিক্রি করে নতুন বাড়ি নিয়েছে। বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসা এবং বাড়ি তাদের পছন্দ না, তেমনি বাবার রেখে যাওয়া বৃদ্ধ মাকেও তাদের আর ভালো লাগছে না।  যেহেতু মাকে বিক্রি করার কোন উপায় নাই , তাই মাকে বৃদ্ধা শ্রমে পাঠিয়ে দেওয়ায় উত্তম মনে করেন তারা। 

শম্পা  ( ছদ্মনাম ) বেগম! সারাজীবন সংসার সংসার করেই নিজের জীবন পার করে দিলেন। গত বছর স্বামীটা গত হয়ে তাকে পুরো একলা করে দিয়ে গেলেন। সারাদিন বাসায় একা একা থাকেন শম্পা বেগম। তার দুই ছেলের মাশাআল্লাহ ৪ছেলে মেয়ে।  কিন্তু শম্পা বেগম তাদের কাছে পান না। শম্পা বেগম কথা বলেন নিজের আঞ্চলিক ভাষায়। এই আঞ্চলিক কথাবার্তা শম্পা বেগমের দুই ছেলের বউ পছন্দ করেন না। তাই তাদের ছেলে মেয়েদের শাশুড়ির সাথে মিশতে দেন না।  অন্যথায় , তারাও এই আঞ্চলিক টানে কথা বলা শিখে যায়। শম্পা বেগমের দুই ছেলের বউ যখন নিজেরা গল্প করেন তখন শম্পা বেগম মাঝে মাঝে তাদের সাথে যেয়ে বসেন। একা একা সারাদিন থাকতে কত ভালো লাগে! এই নিয়েও দুই বউ বিরক্ত।  শম্পা বেগমের দোষ দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিলো। একসময় দুই ছেলে সিদ্ধান্ত নিলেন এমন দোষী মাকে বাসায় রাখা ঠিক না।  তাহলে তাদের সংসারে যেকোনো সময় আগুন ধরে যেতে পারে।  দুই ছেলে সিদ্ধান্ত নিয়ে শম্পা বেগমকে রেখে আসলেন বৃদ্ধাশ্রমে। 

শুধু শম্পা আর রত্না নন। এমন হাজারো শম্পা, রত্নার রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে।  তাদের সবার গল্প ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু পরিস্থিতি সবার এক। নিজের সারাটা জীবন যে সন্তানদের পিছনে ব্যয় করেছেন, শেষ বয়সে সেই সন্তানেরাই তাদের বোঝা মনে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন। আধুনিক ছেলে মেয়েদের স্ট্যাটাসের সাথে নাকি আদিম বাবা মায়ের স্ট্যাটাস যায় না। আধুনিক সন্তানেরা ভুল যান সেই আদিম মানুষগুলো না থাকলে তারা পৃথিবীর আলো দেখতে পেতো না, আদিম মানুষগুলো না থাকলে তারা তাদের আজকের অবস্থানে দাঁড়াতে পারতো না।  

 এই পৃথিবীতে স্বার্থ ছাড়া কেউ কোনো কাজ করে না। শুধুমাত্র বাবা মা'র ক্ষেত্রেই সম্ভব নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে এবং কোনো রকম লাভ ক্ষতির কথা চিন্তা না করে সন্তানের পিছনে তাদের পুরো জীবনটা দিয়ে দেওয়া।  একটা সময় পরে সেই বাবা মা যখন অসহায় হয়ে যান, ঠিক তখনই আমরাও ওদের আরো অসহায় করে দেই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে।  বাবা মাকে যখন আমাদের দরকার ছিলো তখন তারা তাদের পুরোটা দিয়েছে, আর ওদের যখন আমাদের দরকার তখন আমরা ওদের কি দিচ্ছি ? আমরা দিচ্ছি সারপ্রাইজ! বৃদ্ধাশ্রম সারপ্রাইজ! 

Leave a Comment