
বার ড্যান্সার থেকে ন্যাশনাল লেভেলে উঠে আসার সাহসী গল্প!
- ফারজানা আক্তার
- জুলাই ২১, ২০১৮
বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে আমি দ্বিতীয়বার ভাবি নি। আমার বাবা আমাকে কখনো মেনে নিতে পারে নি। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার সাথে সারাক্ষন চিৎকার চেঁচামেচি করতেই থাকতো।
শুধু বাবা নয়, আমার ভাই - বোনেরাও একই ব্যবহার করতো আমার সাথে। পরিবারের সাথে আমার দুরুত্ব দিন দিনকে বেড়েই যাচ্ছিলো। আমি বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় আমার বাবাকে বলেছিলাম আমি বের হয়ে যাচ্ছি। আমার বাবা আমাকে বলেছিলো, 'গেট লস্ট' ।
আমি বাসা থেকে বের হয়ে মুম্বাই রেল স্টেশনে চলে গেলাম। প্রথমদিন আমি শুধু কেঁদেছি। আমার কাছে তখন মাত্র ১৬রুপি ছিলো। দ্বিতীয়দিন আমি সেই ১৬রুপি খরচ করে খেয়েছিলাম।
তৃতীয়দিন একটি লোক আমাকে 'vada pav' (ভারতীয় একটি খাবার। এর বাংলা উচ্চারণ নিয়ে আমি একটু কনফিউসড।) আর এক কাপ চা কিনে দিলো। ওই লোকটি হিজড়া সম্প্রদায়ের ছিলো এবং আমি তার মাধ্যমেই তাদের সাথে যুক্ত হই।
সেখানে যাওয়ার পর আমি তাদের মতো জীবনযাপন করতে শুরু করলাম। আমাকে ৪মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে চুল বড় করার জন্য। হিজড়াদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে 'তালি'। সম্পূর্ণ তাদের মতো হতে আমার সময় লেগেছে।
জীবিকা নির্বাহের জন্য সেই সময় আমি রেল স্টেশনে ভিক্ষা করতে শুরু করলাম। একজন ছেলে যার বাহিরের দুনিয়ার সাথে কোন সম্পর্ক ছিলো না সে জীবিকা নির্বাহের জন্য হাত পেতে পেতে রেল স্টেশনে এবং সিগন্যালে ভিক্ষা করছে। বিষয়টা একবার ভেবে দেখুন তো!
ভিক্ষা করা ছেড়ে দিয়ে আমি যৌনকর্মীর কাজ শুরু করলাম। কিন্তু যৌনকর্মীর কাজে আমি খুব সাচ্ছন্দ্য বোধ করলাম না। আমি তখন আমার এক বন্ধুকে এই সমস্যার কথা বললাম। তাকে আমি এই কথাও বললাম যে কোন বারে বার ড্যান্সার হিসেবে কাজ করতে আমার কোন আপত্তি নেই।
তখন আমার সেই বন্ধু কাছের একটি বারের মালিকের সাথে কথা বলে। সেই মালিক জানালো তারা একজন হিজড়া খোঁজছিলেন যে বার ড্যান্সাররা ড্যান্স শুরুর আগে sai baba 'Aarti' ( সাই বাবা আরতি ) পাঠ করবে। বারের কার্যক্রম শুরুর আগে আরতি পাঠ করা হতো সুভাগ্যের আশায়। আমি সেই কাজে যুক্ত হলাম।
১৭বছর পর যখন আমার বেশ কিছু টাকা জমলো তখন আমার মনে হলো আবার পড়াশোনা শুরু করা উচিত। কারণ একমাত্র পড়াশোনার ফলেই জীবন অন্য রকম হয়ে যেতে পারে। ফেইক ডুপ্লিকেট সার্টিফিকেট দিয়ে আমি একটি নামকরা কলেজে ভর্তি হলাম।
আমার কাস্টমারকে রাজি করলাম আমার ফেইক বাবা - মা হতে। শুরু হলো আমার শিক্ষা জীবন। দিনে ক্লাস করতাম আর রাতে বারে কাজ করতাম। ৫বছর ধরে আমি এভাবেই আমার পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি। আমি আমার গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করেছি।
আমাদের বারে কিছু ভলান্টিয়ার আসতো এইচআইভি সম্পর্কে সচেতন করার জন্য। আমি তাদের সাথে ভলান্টিয়ার কাজ শুরু করি। ২০১০ সালে India HIV Aids Alliance থেকে আমার কাছে একটি কল আসে।
তারা আমাকে তাদের সাথে কাজের অফার করে। আমি ৪বছর ধরে তাদের সাথে একটি ন্যাশনাল লেভেলের প্রোজেক্টে কাজ করছি। এই প্রোজেক্টটি ১৭টি রাজ্য ধরে আছে। আমি গর্বিত কারণ আমি বার ওয়ার্কার থেকে আজকে এই পর্যন্ত উঠে এসেছি। শুধু বার ওয়ার্কার নয়, আমি সেক্স ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করেছি, ভিক্ষাও করেছি।
সমাজের মানুষ বলে হিজড়ারা খারাপ। তারা টাকা ছাড়া কিছু বুঝে না। আমি বলতে চাই হিজড়ারা টাকা ছাড়া কিছু বুঝে না কারণ তোমার তাদের কোন কাজ দাও না। তোমরা তাদের আগে কাজ দাও, তোমরা আগে তাদের মানুষ বলে মনে করো তারপর তাদের নিয়ে অভিযোগ করো।
আমি যখন এখন আমার পেশেন্টদের নিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে চেকআপের জন্য যাই, ডাক্তাররা ওদের গায়ে হাত পর্যন্ত দিতে চায় না। হিজড়াদের সমাজের মানুষ, এই সমাজ মানুষ বলেই মনে করে না।
বাসা থেকে বের আসার পর একবার বাবাকে ফোন দিয়েছিলাম। আমার বাবা আমাকে বলেছিলো আমি তাদের কাছে মৃত। সেদিনই আমার শেষ আশাটাও শেষ হয়ে গেলো। আমি যখন বাসা থেকে বের হই আমার কোন পারিবারিক এবং সামাজিক সাপোর্ট ছিলো না।
আজকে আমার সামাজিক সাপোর্ট আছে। আর, এখন মনে হয় আমার এমন বাবা মায়ের কোন দরকার নেই। উপরওয়ালার সবথেকে সুন্দর এবং সেরা সৃষ্টি মানুষ। হিজড়ারাও মানুষ, আপনি তাদের আলাদা করে দেখছেন, হেয় করছেন তার মানে আমি উপরওয়ালাকে অসম্মান করছেন।
উপরের কথাগুলো একজন ভারতীয় তৃতীয়লিঙ্গ সিমরানের। মুম্বাই শহরের এক কলোনীতে যার জন্ম হয়েছে। ছোটবেলা দেখতে সে ছেলেদের মতো কিন্তু মেয়েদের পোশাক এবং মেয়েদের স্বভাবই তার পছন্দ। যে বয়সে ছেলেরা মেয়েদের নিয়ে ভাবতে শুরু করে, সে বয়সে সিমরান মেয়ে হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
সিমরানের এই মেয়ে মেয়ে স্বভাবের জন্য পরিবার থেকে তাকে রাতদিন গালাগাল করা হতো। আশপাশের কেউ সিমরানের সাথে মিশতো না। একটা সময় সিমরান নিজেকে নিয়ে দোটানায় পড়ে যায় সে আসলে কি! ছেলে, নাকি মেয়ে? পরিবার এবং আশেপাশের সাপোর্ট না পেয়ে সিমরান ১৪বছর বয়সে বাসা থেকে বের হয়ে যায়।
( ভারতীয় টিভি চ্যানেল ষ্টার প্লাসে একটা প্রোগ্রাম হয় Satyamev Jayate.এই প্রোগ্রামটি আমার কখনো দেখা হয় নি। এক ভাইয়া আজকে সকালে সিমরানের এই প্রোগ্রামটির লিংক দিলো। বলিউড অভিনেতা আমির খান এই প্রোগ্রামটি উপস্থাপনা করেছেন। প্রোগ্রামটি দেখেই মনে হলো এটা নিয়ে লিখতে হবে।
আমি হিন্দি বুঝি না, ইংলিশ সাবটাইটেল ছিলো। কিন্তু তারা কথা বলে আগে, সাবটাইটেল আসে পরে। নিজের মতো করে চেষ্টা করেছি সিমরানের জীবনের গল্পটি সাজিয়ে তোলার। ভুলগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। )