বিবাহিত জীবনে এডজাস্ট করবো, নাকি স্যাক্রিফাইজ করবো!
- ফারজানা আক্তার
- সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৮
নাবিলা এবং রাসেলের বিবাহিত জীবনের এইতো বছর ঘুরতে চললো। দুইজনেই খুব ভালো চাকরি করে। সংসারের শুরুর দিক থেকে দুইজন মিলেমিশেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে এবং নিজেদের পছন্দ অপছন্দ মূল্যায়ন করেই তাদের জীবন সুন্দরভাবে চলছে। সংসারের শুরুর দিকে দুইজনের অবশ্য কিছুটা সমস্যা হয়েছিলো। যেহেতু দুইজনই চাকরি করে, তাই অফিস শেষ করে এসে রান্নাবান্না, ঘরদোর গুছানোর এনার্জি কারোই থাকে না। কয়েকদিন বাহিরে বাহিরে খেয়ে দুইজনের অবস্থাই খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। গ্রাম থেকে বহু কষ্টে একজন পার্মানেন্ট বুয়া যোগাড় করা গেলো।
দুইজনেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো! এই বুঝি সব ঝামেলার অবসান হলো। কিন্তু না! ঝামেলা রয়েই গেলো। নাবিলা ঝাল ঝাল তরকারি ছাড়া একদম খেতে পারে না। কাঁচা বা শুকনো ঝাল ওর পছন্দ না। তরকারির ঝালই ওর পছন্দ। অন্যদিকে রাসেল একদম ঝাল খেতে পারে না। মাঝখান থেকে বুয়ার সাফ সাফ কথা দুইজনের দুই রকম রান্না সে করতে পারবে না। যেকোন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে যেন তাকে বলে দেওয়া হয়।
সমাধান নাবিলাই দিলো। বুয়াকে বলা হলো ঝাল বিহীন তরকারি রান্না করতে। বুয়া নাবিলাকে জিজ্ঞেস করলো ঝাল বিহীন তরকারি তো নাবিলার পছন্দ না। ঝালবিহীন তরকারি রান্না করলে সে খেতে পারবে তো! নাবিলা উত্তর দিলো অনেকদিন ধরেই ঝাল খাওয়া সে কমাতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। এই সুযোগে যদি ঝাল খাওয়া কমানো যায় তাহলে মন্দ কি! ঘুমানোর আগে শুয়ে শুয়ে বই পড়া নাবিলার ছোট বেলার অভ্যাস। অন্যদিকে, রুম একেবারে পুরো অন্ধকার না হলে রাসেল ঘুমাতে পারে না। নাবিলা সেই জায়গাও নিজের অভ্যাস পরিবর্তন করে নিলো।
আরো পড়ুন: বার ড্যান্সার থেকে ন্যাশনাল লেভেলে উঠে আসার সাহসী গল্প!
ঝাল খাওয়া কমিয়ে দিয়ে, শুয়ে শুয়ে বই পড়ার অভ্যাস ত্যাগ করে নাবিলা রাসেলের সাথে এডজাস্ট করে নিলো। প্রতিটা সম্পর্কে দুইজনের পক্ষ থেকে ছোট ছোট এডজাস্টমেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু দুইজন মানুষ দুই রকম পরিবেশে বড় হয়, দুইজনের অভ্যাস, চিন্তা -ভাবনা ভিন্ন হয় তাই প্রথম প্রথম একসাথে থাকার সময় প্রব্লেম হবে এটা স্বাভাবিক। একটি সম্পর্কে একপক্ষ এডজাস্ট করে গেলো, আর অন্যজন নির্বিকার রয়ে গেলো তাহলে সে সম্পর্কে কখনো সুখ আসবে না। কারণ একপাক্ষিক এডজাস্টমেন্টে একটা সময় যেয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। তখন সে নতুন করে এডজাস্ট করার কিছু পায় না। অতীতের নিজের একপাক্ষিক এডজাস্টমেন্টের জন্য তখন তার মনে অনুতাপ হয়। সেই অনুতাপের জন্য নিজের সংসার বা সঙ্গী কাউকেই আর আগের মতো ঠিক ভরসা করতে পারে না। অতীতের মতো করে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে ভালোবাসতে পারে না।
আনিকা আর আবিরের বিয়ের ছয় মাস পূর্ণ হলো। আনিকা অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। খুবই ভালো ছাত্রী আনিকা। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখেছে একজন ব্যাংকার হওয়ার। আনিকার ইচ্ছে ছিলো পড়াশোনা শেষ করে জবে ঢুকে বিয়ে করবে। ভালো পাত্র যেমন কোন বাবাই হাতছাড়া করতে চায় না, তেমনি আনিকার বাবাও আবিরকে হাত ছাড়া করতে চায়নি।
বিয়ের আগে পাত্র পক্ষ কথা দিয়েছে বিয়ের পর আনিকা পড়াশোনা, জব করতে পারবে। এই বিষয়ে তাদের কোন আপত্তি নেই। মহা ধুমধামে আনিকা আর আবিরের বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়ে, দাওয়াত, হানিমুন, নতুন বাড়িতে এডজাস্ট সব করতে করতে বিয়ের ১মাস পার হয়ে গেলো। সেদিন আনিকা ভার্সিটিতে যাবে। তাই সকাল সকাল সবাইকে নাস্তা রেডি করে দিয়ে নিজে রেডি হচ্ছিলো। আনিকার শ্বাশুড়ি আনিকাকে জিজ্ঞেস করলো আনিকা কোথায় যাচ্ছে। আনিকা বললো ভার্সিটিতে যাচ্ছে।
আরো পড়ুন: ছেলে দুঃখ নিয়ে বলে! আমি কার বউয়ের, নাকি মায়ের?
হঠাৎ করে আনিকার শ্বাশুড়ি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলো। তিনি বলতে থাকলেন সারাজীবন এই সংসারে কলুর বলদের মতো তিনি খেটে গিয়েছেন। ভেবেছিলেন ছেলের বউ আসলে একটু আরাম করবেন। কিন্তু তার পোড়া কপাল! ছেলের বউ এখন জজ ব্যারিস্টার হতে চায়। বিয়ের পর মেয়েদের পড়াশোনার কি দরকার তিনি বুঝেন না। আনিকা চুপচাপ নিজের রুমে বসে আবিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আনিকার বিশ্বাস আবির নিশ্চয় এর পজেটিভ সমাধান বের করবেন।
আবির আনিকাকে বললো মেয়েরা তো একটি ভালো বিয়ে করার জন্যই পড়াশোনা করে। আনিকার তো ভালো বিয়ে হয়ে গেছে। পড়াশোনা করে আর কি হবে! আনিকা বললো সে ভালো বিয়ের জন্য পড়াশোনা করেনি। সে নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য পড়াশোনা করেছে এবং সে এখনো চালিয়ে যেতে চায়। আনিকা নিজের একটি পরিচয় চায়। আবির মায়ের উপরে কোন কথা বলতে পারবে না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। সেদিন আনিকা ভার্সিটিতে যেতে পারেনি। পারেনি আর কোনোদিনও শ্বশুর বাড়ি টপকে ভার্সিটিতে পা রাখতে। আনিকা পারেনি নিজের স্বপ্নের জায়গা ব্যাংকে চাকরি করতে।
সংসারের শান্তির জন্য অথবা সংসারটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য আনিকা নিজের স্বপ্নকে স্যাক্রিফাইজ করে দিলো। নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়েও কি আনিকারা এমন সংসারে, এই রকম দুমুখো মানুষদের সাথে শান্তিতে থাকতে পারে। বিয়ের এক মাস পরেই যে মানুষগুলোর আসল রূপ বের হয়ে আসে, এক বছর পর যে তারা আরো কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটা ধারণা করা কি খুব কঠিন!
আরো পড়ুন: সম অধিকার চাওয়া মেয়েরা সম দায়িত্ব নিতে নারাজ! কিন্তু কেন?
আমরা বুঝি না আমাদের কতটুকু এডজাস্ট আর কতটুকু স্যাক্রিফাইজ করা উচিত। আমরা শুধু ভাবি সংসারটা আমার! মানুষটা আমার! মানুষগুলো আমার! তাই নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছে , সাধ -আহ্লাদকে বিসর্জন দিতে দ্বিতীয়বার ভাবি না। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি? 'আমিও যে আমার!' আমরা সবাই আগে নিজের, পরে অন্যের। স্যাক্রিফাইজ নামক শব্দের মধ্য দিয়ে আমরা আসলে আমাদের আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিয়ে দেই। সব মেয়েকেই নিজের একটি পরিচয় তৈরী করা উচিত। কারণ দিনশেষে সংসার , সংসারের মানুষ আপন গতিতে চলে। তখন নিজেকে খুব শূন্য মনে হয়। নিজের অস্তিত্ব বলতে তখন কিছুই থাকে না। এডজাস্টমেন্ট আর স্যাক্রিফাইজ শব্দের মাঝে নিজের স্বপ্নটাকে কখনোই চাপা দেওয়া উচিত না , কখনোই না।