ছেলে দুঃখ নিয়ে বলে! আমি কার বউয়ের, নাকি মায়ের?
- ফারজানা আক্তার
- সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৮
সংসার জীবনে শুধু মেয়েদের পাওয়া, না পাওয়া , আক্ষেপ, শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন নিয়েই কথা হয়। এবং এই বিষয়ে কথা বলাও স্বাভাবিক কারণ সংসার জীবনে মেয়েরাই বেশি ভিকটিম হয়ে থাকে। মেয়েদের সমস্যার আড়ালে রয়ে যায় ছেলেদের উভয় সংকট নানান বিষয়। সারাক্ষণ হৈহৈ রৈরৈ করে বেড়ানো ছেলেটিও বিয়ের পর কেমন যেন অজানা আশংকায় চুপসে যায়। ছেলেদের এই চুপসে যাওয়া কি শুধুই অর্থনৈতিক, নাকি অনেকটা পারিবারিক!
সায়েম মায়ের একমাত্র আদরের ছেলে। এই যে এতো বড় ছেলে হয়েছে এখনো মায়ের হাতে খাবে। অফিস থেকে বাসায় ফিরে সবার আগে মাকে জড়িয়ে ধরবে। মায়ের কোলে মাথা রেখে ফোন টিপবে। এই মায়ের কোলে মাথা রেখে ফেসবুকিং করতে করতেই পরিচয় হয় শায়লার সাথে। পরিচয় পরিণয়ের পরে আসে বিয়ের কথা। দুই পরিবারকে জানানোর পরই ঠিকঠাকভাবে তাদের বিয়েটাও হয়ে যায়। বিয়ের পর শুরু হলো আসল সমস্যা।
বিয়ের আগে সায়েম অফিস থেকে ফিরে মাকে সময় দিতো। এইদিকে মা সায়েমের পছন্দের খাবার রান্না করে নিজের হাতে খায়িয়ে দিতো। সায়েমের রুম, জামা কাপড় নিজ হাতে গুছিয়ে রাখত। তখন সায়েমের এটা সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই মায়ের সময় পার হয়ে যেত। ঘরে বউ আসার পর এখন মায়ের এই দায়িত্বগুলো বউয়ের হয়ে গিয়েছে। শায়লা আসার পর নিজের হাতে রান্না করে। একসাথে খেতে বসলে শায়লা নিজের হাতেই এটা সেটা তুলে দেয় সায়েমের পাতে।
বউয়ের সামনে সায়েম মায়ের হাতে খায় না এখন। একদিন সকালে নাস্তা করেছিলো , সে কথা নিয়ে এখনো শায়লা সায়েমকে খুব পঁচানি দেয়। বিয়ের পর অফিস থেকে ফিরে সায়েম মা আর বউকে নিয়ে একসাথে গল্প করতে বসতো। কিন্তু শায়লা সেটা তেমন পছন্দ করে নি। কারণ দিনশেষে শায়লা তার স্বামীর সাথে একান্ত সময় কাটাতে চায়।
সায়েম মায়ের ব্যাপারটা বুঝে , আবার বউয়ের টাও। ছোটবেলা সায়েমের বাবা মারা গিয়েছে। মা একা হাতে তাকে মানুষ করেছে। মায়ের একাকীত্ব এবং কষ্টটা সায়েম বুঝতো বলেই বন্ধুদের সাথে তেমন সময় কাটাতো না। যতটা সম্ভব মাকেই সময় দিত। এইদিকে বিয়ের পর প্রতিটা মেয়েই স্বামীর সাথে একান্ত কিছু সময় কাটাতে চায় , নিজের হাতে তার জন্য রান্না করতে চায় ইত্যাদি। এবং এটা স্বাভাবিক।
আবার, শায়লাকেও বুঝতে হবে পরিবারে যেহেতু এক মা ছাড়া অন্য কেউ নেই, তাই একেবারে হুট্ করে সবকিছু থেকে তাকে ছুটিও দেওয়া যায় না। আগে মা সারাক্ষণ ঘরের কাজে এটা সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো বলে তেমন একাকিত্ব বোধ করতো না। এখন পুরো দিন অবসর, আবার ছেলে বাসায় ফিরেই বউকে নিয়ে ব্যস্ত। মায়ের যেন সময় কাটে না।
সংসারে শুরু হলো মান অভিমান। সারাদিন বউ শ্বাশুড়ি একে অন্যকে খোঁচা মেরে কথা বলে। সায়েম বাসায় ফেরার পর দুইপক্ষ অভিযোগ করে। মায়ের পক্ষে কথা বললে বউ গাল ফুলিয়ে রাখে, বৌয়ের পক্ষে কথা বললে মা গাল ফুলিয়ে রাখে। বউ বলে, 'এতো মা ভক্ত হলে বিয়ে করলে কেন! মায়ের দোষ চোখে পড়ে না। সব পরের মেয়ের দোষ। ' মা বলে, 'বিয়ের পর পেটের ছেলে যে এতো পর হয়ে যায় নিজের সাথে না ঘটলে বুঝতেই পারতাম না!'
সায়েম সরাসরি কাউকে দোষ দিচ্ছে না। বিষয়টা হচ্ছে কেউ কারো জায়গা ছাড় দিতে রাজি নয়। সময়ের সাথে সাথে যে মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন আসে সেটা তারা মানতে নারাজ। নিজের সুখের কিছু অংশ অন্যের সাথে ভাগাভাগি করলে যে সুখ কমে না বরং বেড়ে যায় সেটা তারা বুঝতে পারে না।
আগে সায়েমের মনে হতো কখন অফিস ছুটি হবে আর কখন বাসায় আসবে। এখন সায়েমের মনে হয় অফিসে যতক্ষণ থাকা যায় ততক্ষণই শান্তি। খোঁচা দেওয়া কথার থেকে বসের ঝাড়ি অনেক ভালো বলে সায়েমের কাছে মনে হয়। সায়েমের মনে হয় মা যদি এমন বাঁকা বাঁকা কথা না বলে ওর দুই গালে দুইটা থাপ্পড় দিতো তাও ভালো ছিলো। সায়েম চেয়েছিল মা এবং বউ দুইজনকে নিয়ে সুখের সংসার করতে কিন্তু মাঝখান থেকে সে দুইজনের কাছেই ভিলেন হয়ে গেলো। সুখ তো অনেক পরের কথা।
সায়েম মাত্র একটি উদাহরণ। আমাদের সমাজে এমন হাজারো সায়েম আছে যারা এমন পারিবারিক অশান্তি নিয়ে বেঁচে আছে। বিয়ের আগে এবং পরের জীবনে বিশাল পার্থক্য হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে মায়েরা এই বিষয়টা বুঝে কিন্তু ছেলে সন্তানদের বেলায় এই বিষয়টা বুঝতে চায় না। ছেলের বৌকে তারা প্রথম থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। আর, বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীকে নিজের সম্পত্তি মনে করে আর স্বামীর পরিবারকে আগাছা। শাশুড়ি আর বউয়ের দুই ধরণের ভাবনার মাঝখানে পিষ্ট হয় ছেলে নামের মানুষটি।