নারীর আত্নহত্যার পাঁচ কারন
- মারুফ ইমন
- এপ্রিল ১২, ২০১৯
৮ এপ্রিল ২০১৯, জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর একটা রিপোর্ট দিয়ে শুরু করছি। সেখানে বলা হচ্ছে, গত তিন মাসে শুধুমাত্র আশুলিয়া এলাকায় ২৬ জন নারী ও সাভারে ১৬ জন নারী আত্মহত্যা করেন। এ ছাড়া গত বছরে আশুলিয়ায় আত্মহত্যা করেছেন ৬৩ জন এবং সাভারে ৩০ জন। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রিজাউল হক বললেন, ঢাকার মধ্যে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকা। প্রায় প্রতিদিনই এই এলাকায় দুই-একজন নারী আত্মহত্যা করছেন। অনেক আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশকে জানানোই হয় না।
নারীকে একটি পরিবারের খুটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নারী তার আপন মনোবল ও শক্তিতে বাধা বিপত্তি এড়িয়ে এগিয়ে চলছে। এই চলার পথে সবাই সব বিপত্তি কে তার মনের শক্তি দিয়ে পাশ কাটাতে পারে না। সেক্ষেত্রে দরকার হয় আপনজন আর কাছের মানুষদের একটু সহযোগীতা। আর সেটা না পেলে অনেকেই বেছে নেন পৃথিবীকে বিদায় জানানোর পথ। তবে যেই মূল পাঁচটি কারন কে বাংলাদেশে নারীদের আত্নহত্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা যায় সেগুলো নিয়ে একটু কথা বলা যাক।
দাম্পত্য কলহঃ একজন স্বাবলম্বী ও আত্ননির্ভরশীল নারী যখন নিজেই মারা যায় তখন অনেককে দেখেছি মানতে পারেন না । এই ভাবেন যে, এই মহিলা কেন আত্নহত্যা করবেন, এর তো চাকরি ছিল বা সে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এসব ক্ষেত্রে বিয়ে পরবর্তী সময়ে স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়া কিংবা প্রেমিকের সাথে কলহ বড় কারন হিসেবে কাজ করে। প্রথমত, স্বামীর অবহেলা কিংবা বাজে চারিত্রিক অভ্যাস আর যৌথ পরিবারে থাকলে শ্বশুড় শ্বাশুড়ির সাথে বিবাদ কলহের দানা বাধে। বিয়েটা যদি পূর্ব সম্পর্কের কারনে হয় তবে প্রেমঘটিত কিছু সন্দেহ আর বাজে ঘটনা বিয়ের পরেও গড়ায় কথায় কথায়। এতে বিবাহ বিচ্ছেদের পরও মানসিক যন্ত্রণায় অনেকে নিজের জীবনকে মূল্যহীন ভাবতে শুরু করে। এর জেরে নারীরা আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার, বিবাহবিচ্ছেদ না হলেও দেখা যায় কোনরকম কিছু গটবাধা রুটিন আর দায়িত্বপালনে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় স্বামী স্ত্রীর বৈবাহিক জীবন । এর ফরশ্রুতিতে স্বামীর পরকীয়া বা চরম অবহেলা অনাগ্রহে স্ত্রী অপমানে আর লজ্জায় আত্নহত্যা করেন ।
সম্পর্ক-ছেদঃ বৈবাহিক কিংবা প্রেম যেকোন ধরনের সম্পর্কে ছেদ নারীমনে বিরূপ প্রভাবে ফেলে। আর এক্ষেত্রে যদি সম্পর্কটি অনেক দিনের পুরনো হয় তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা সেটি কাটিয়ে উঠতে পারে না দ্রুত। তখন তারা কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যার মধ্যে একটি হল, আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়া। এইসময় তারা একা থাকতে পছন্দ করে ও সবাইকে অবিশ্বাস করে। কারো কাছে তার সম্পর্কের ভাঙনের কথা বলতে চায় না বলে এড়িয়ে চলে। এই একাকীত্ব তাদের ঠেলে দেয় অনিশ্চয়তার দিকে। অনেক সময় অনেক অন্তঃরঙ্গ সম্পর্কের পরিণতি যদি বিয়োগাত্নক হয়, তবে গোপন ছবি বা ভিডিও তার প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে থেকে যায়। এটি তার মনে মারাত্নক ভয়ের সৃষ্টি করে। কেউ জানার আগে সে লজ্জায় মৃত্যুকে একমাত্র 'এক্সিট পয়েন্ট’ মনে করে।
পারিবারিক সংকটঃ বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারে অর্থ সংকট বা অভাব অনটনের কারনে মেয়েদের মাঝে অনেক সময়ই দেখা দেয় হতাশা ও ধৈর্যচ্যুতি। পরিবারে অর্থকষ্ট, পড়াশোনার খরচ আর সুচিকিৎসার খরচ যোগাতে ব্যর্থ হলে মেয়েরা অনেক সময় হতাশ হয়ে পড়ে। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে কিশোরী মেয়েদের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়। তখন তারা কি করবে বুঝতে পারে না। আবার কোন বড় দূর্ঘটনার কারনেও অনেকে জীবনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে আর সঠিক পথে ফিরতে পারেন না। কর্মজীবি মহিলাদের একটা অংশ পারিবারিক দায়িত্ব পালন করতে করতে তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে হারিয়ে ফেললে , পরে নিজের বিয়ে বা পরিবার নিয়ে ভাবার অবকাশ পায় না। এরা এই সংকটে খুব একা হয়ে পড়ে এবং সঙ্গীহীন জীবনযাপন করে। তার মাঝে অনেক সময় অন্যের সুখের জীবন ঈর্ষার জন্ম দেয়। চরম ব্যর্থ মনে করে জীবনকে তারা অর্থহীন মনে করে।
মানসিক আঘাতঃ আবেগীয় কারনে মেয়েরা বড় কোন ধাক্কা নিতে অপারগ হলে সেটা একটা স্থায়ী রূপ ধারন করে। ট্রমায় পরিণত হলে সেটা কাটাতে অনেক সময় লেগে যায়, অনেকে সেটা কাটাতেও পারে না। তখন অনেকটা নিজের নির্বুদ্ধিতায় মেয়েটি নিজেকে স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ট্রমা যেসব কারনে হয় তার মধ্যে পরিবারের কারো জীবননাশ, নিজের কোন পক্ষাঘাত বা আহত হয়ে শরীরের কোন অঙ্গহানি বা পর্যদুস্ত হওয়া অন্যতম। এসব কারনে মানসিক আঘাত সবাই সহ্য করতে পারে না। প্রতিবন্ধীদের মধ্যেও অনেককে দেখা যায় তার সীমাবদ্ধতার জন্য সমাজের কাছ থেকে শুনতে হয় বিরূপ প্রতিক্রিয়া। সেটা জমতে জমতে একসময় চূড়ান্ত আত্নবিশ্বাসহীনতায় পর্যবসিত হয়। এছাড়াও বৈবাহিক জীবনে স্বামীর হাতে নির্যাতনেও অনেক স্ত্রীরা জীবনের বেঁচে থাকার মানে হারিয়ে ফেলেন। এই আঘাত তারা কারো সাথে ভাগাভাগিও করতে চান না।
সামাজিক অধঃপতনঃ সামাজিকভাবে অধঃপতনের মূল কারন পরিবারের উদাসীনতা আর তার সাথে বাজে সঙ্গ । সাধারনত, নেশাগ্রস্থ মেয়েরা নেশার অভাবে কিংবা চরম শারীরিক ঝুকিতে থাকলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। উপযুক্ত সেবার অভাবে তারা এই নেশাহীন সময়ে মারাত্নক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যায় এবং অনেক সময় ভালভাবে সময় নিয়ে চিন্তা না করেই আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়। সঙ্গদোষে অনেক সময় টিনেজার মেয়েরা নেশায় ঝুকে পড়ে এবং কারো কথা না শুনে উশৃঙ্খল জীবন যাপন করতে থাকে। বাবা মা সেই পথ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে দেরি করে ফেললে মেয়েটি একইসাথে হয়ে পড়ে একা ও নেশাহীন। পুনর্বাসন বা যথাযথ চিকিৎসা না নিলে মেয়েটি যেকোন বিপদ ঘটিয়ে ফেলতে পারেই। আর কমবয়েসী মেয়েদের ইগো, আবেগ এবং সম্পর্কজনিত জটিলতা থাকে বেশি। তাই তাদের নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন ঘটে।
মেয়েদের আত্নহত্যার এই কারনগুলি আমাদের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মনোবিদ ও সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত মানুষদের লেখা ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরনে লেখা। উপরোক্ত কারন ছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের আলোকে বিভিন্ন কারন রয়েছে। সবক্ষেত্রেই পরিবারের মানুষদের গুরুত্ব দিয়ে কাউন্সিলিং করা ও পরবর্তীতে তাদের সাথে আলাপ করে সমস্যাগুলো বুঝতে চেষ্টা করা জরুরী।