বিচ্ছেদের পরেও বন্ধুত্ব!
- মারুফ ইমন
- জুন ২২, ২০১৯
'বিয়ের পরেও মিথিলার কাছে যান তাহসান' টাইপের খবরের শিরোনাম দেখে যতটা না বিরক্তি লাগলো তার চেয়ে মায়া লাগলো বেচারা রিপোর্টারের জন্য। মানুষকে খবরের ভিউ বাড়াতে তার শিরোনামের এমন সংকট খুবই নিদারুন। যারা অল্পবিস্তর এই তারকা জুটি সম্পর্কে জানেন তারাও চট করে ধরে ফেলবেন মেয়ে আইরা কে দেখতে যাওয়াটা বাবা তাহসানের জন্য খুব সাধারন, আর তিনি সেটাই করেছেন। আর আইরা তার মা মিথিলার সাথে থাকে বলে তাহসান কে তো তার কাছেই যেতে হবে।
আজকের লেখাটি যারা শুধুমাত্র সম্পর্ক করে সেটি ভেঙেছেন তাদের জন্য নয়, যারা করবেন বা অজান্তে কারো সাথে হয়তো জড়িয়ে যেতে পারেন নিকট ভবিষ্যতে তাদের সবার জন্যই। একটা জানাশোনা বিচ্ছেদ ও বন্ধুতার গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। ‘একটা ছেলে মনের আঙিনাতে ধীর পায়েতে এক্কা দোক্কা খেলে... বন পাহাড়ী ঝর্না খুঁজে, বৃষ্টি জলে একলা ভিজে, সেই ছেলেটা আমায় ছুঁয়ে ফেলে...’ - যারা গানটি শুনেছেন তারা তো জানেনই ‘একটি ছেলে’ গানটির ছেলেটাই বা কে আর মেয়েটাই বা কে! না জানলেও এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলার কথা।
ক্লাস থ্রি’র শান্তিনিকেতন। তখন থেকেই তারা ছিলেন একসঙ্গে। তুখোর বন্ধুত্ব। প্রেম বোঝার বয়স হয়নি কারোই। একটা বছর পেরুল কোনমতে। ক্লাস ফোরে পড়া অবস্থাতেই অর্ণবের প্রেমটা গড়ায় সাহানা বাজপেয়ির দিকে। যদিও মেয়েটা জানত না সেটা।‘বড় হলে আমি সাহানাকে বিয়ে করব’, অর্ণব তো বলেই বসলেন সাহানার এক বন্ধুকে! তারপর আর কী... জেনে ফেলল সাহানা। ওই বয়সের পুঁচকে মেয়েটি কী আর প্রেমের মর্ম বোঝে! বলে দিলেন স্যার কে। তো যা হয়, অর্ণবের কান ঝালাপালা হয়ে গেল বকুনিতে। তাতে কী! ক্লাস আট কী ন’য়ে উঠতে না উঠতেই জমে গেল দুজনার প্রেম।
একটা সময় বিয়েও করে ফেললেন তারা। ছোটবেলার কথা রাখলেন অর্ণব। চলছিল সংসার জীবন। তারপর কিছু ঠিকঠাক না চলা অতঃপর বিচ্ছেদ। পরে এক সাক্ষাৎকারে অর্ণব বললেন, ‘সাহানা তো আসলে আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে শান্তিনিকেতনে ক্লাস থ্রি থেকে পড়েছি। খুব অল্প বয়সে বিয়ে করি আমরা। সাত বছরের বিবাহিত জীবন। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চাওয়া, পাওয়া তো পাল্টায়। সাহানা লন্ডনে পড়াশোনা করতে যায়। ও এখন বিবাহিত। কিন্তু আমরা পরস্পরের বন্ধুই আছি।’
সেলিব্রেটি লেভেলে সম্পর্ক যতটা না আলোচনার বিষয় তার চেয়েও বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় সেই সম্পর্কটির ভাঙন। মিডিয়া সেই খবরটিই হয়তো ফলাও করে প্রচার করে। ব্যক্তিদের সাথে কথা বলার সময়ও তারা সম্পর্ক নিয়েই খোঁচাখুচি করতে পছন্দ করে, কারন তাদের একটা বড় অংশের ধারনা এটি পাবলিক বেশি 'খাবে’। একটু খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের সাথে এই জায়গায় সেলিব্রেটিদের ভাল মিল। আমাদের চারপাশে কিছু মানুষ আছে তারা আপনার থেকেও আপনার ভাঙা সম্পর্ক নিয়ে খোঁচাখুচি করতেই বেশি পছন্দ করে। ব্রেকাপের পরে বন্ধুতা কঠিন হয়ে যায় এমন কিছু কারনে।
বিচ্ছেদ, ব্রেকাপ, ডিভোর্স বা সেপারেশন যাই বলুন সবগুলোর একটা কমন দিক হল, ‘আলাদা’ হয়ে যাওয়া। এরপরও বন্ধুত্ব বজায় রাখা আসলে কতটুকু যৌক্তিক বা সম্ভব ? যৌক্তিকতার কথা বললে প্রথমে আসে, বিচ্ছেদটা আসলে কতটা ভালভাবে হয়েছে তার ওপর। যেমন, দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ আর বিরক্তির যে সম্পর্ক সেখান থেকে চলে আসাটা বাস্তবিক। তাই এরপর দুজনের কেউ আর কারো সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না। অনেকসময় একজন চায়, অন্যজন হয়তো চায়না। সেক্ষেত্রে বন্ধুত্ব ধরে রাখা খুবই কঠিন। আবার, আপনার বিচ্ছেদ হতে পারে পরিকল্পনা মাফিক ও গোছানো। দুজন হয়তো আলোচনার ভিত্তিতে নিজেদের ও পরিবারের সাথে আলাপের মাধ্যমেই সিদ্ধান্তে এসেছে। তাদের বিচ্ছেদের পরে ভাল একটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখা খুবই সহজ ও সহজাত হতে পারে। আর যদি সন্তান তাদের যে কারো কাছে থাকে ,তবে আইনগত কারনেই বন্ধুত্ব ধরে রাখা জরুরি হয়ে পরে তাদের ।
বিয়ের আগের প্রেমের সম্পর্কগুলির বেশিরভাগ শুরুই হয় বন্ধুত্ব থেকে। তাদের জানাশোনা আর বোঝাপড়া থাকে খুবই ভাল। যে সম্পর্কের ভিত্তি হয় বন্ধুত্ব সেটি ভেঙে গেলেও ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমারতের মত সেখানে পড়ে থাকে বন্ধুত্বের ধ্বংসাবশেষ। সেই অংশটুকু পা না মাড়িয়ে রেখে দেয়া যেতে পারে দেয়ালের খোপে।
আপনি যার সাথে এতটা সময় কাটিয়েছেন, আবেগ ভাগাভাগি করেছেন, একসাথে ভবিষ্যতের একটা সুন্দর সময় কাটাবেন বলে পরিকল্পনা করেছেন তার সাথে আপনার বিচ্ছেদ হয়ে গেলে স্বভাবতই অনেকটা হতাশ হয়ে ভেঙে পড়ার কথা। এই সংকট কাটাতে পারস্পরিক সম্মানবোধ খুব জরুরি। একেকজনের বিচ্ছেদের কারন বা পরিস্থিতি অন্য কেউ ততটা বা সামান্যও বুঝবে না। আপনার মনোকষ্ট আপনাকেই ঠিক করতে হবে যথাসম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করেই। সেটার উত্তোরন আপনারই হাতে। আমি শুধু কিছু পথ দেখিয়ে দিতে পারি। মোটামুটি এই কয়টি পথে গেলে আপনার আন্তরিক ইচ্ছা স্বাভাবিক জীবনে খুব দ্রুত আপনাকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
১। নিজেকে সময় দিন। সম্পর্ক বিচ্ছেদের জন্য সময়হীনতা খুব কমন একটি পয়েন্ট। বেশিরভাগ যুগলের অভিযোগ তারা নিজেদের যথেষ্ট সময় দেয় নি। তাই বিচ্ছেদের পর প্রথমত আপনি ভেবে নিতে পারেন, আপনার হাতে এখন নিজেকে নিয়ে ভাবার চিন্তার অনেক সময় আছে। আপনার এক্স আপনাকে সময় না দিলেও আপনি কী নিজেকে এখন সময় দিয়ে নিজের পরিস্থিতি, ভবিষ্যত, পরিবার আর ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে পারেন না? নিশ্চই পারেন।
২। নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। চলে যাওয়া সম্পর্ক বা মানুষটিকে নিয়ে যত ভাববেন এখন ততই ক্ষতি। এটি ঠিক, খুব দ্রুত কম্পিউটারের কোন ফোল্ডারের মত চাইলেই মেমোরি ডিলিট করে দেয়া যাবে না, কিন্তু আপনার ব্যস্ততা বা অন্য কিছুতে আগ্রহ আপনাকে সাহায্য করবে ভুলে থাকতে। তাই ঘরের কাজ, পড়াশুনা, সৃজনশীল কিছুতে ব্যস্ত থাকতে পারেন।
৩। কোথাও ঘুরে আসুন। বায়ু পরিবর্তন সত্যি কাজে দেয়। দেখা যায়, আপনি আপনার স্থানে পড়ে থাকলে বারবার স্মৃতি বা ভালমন্দ সময়গুলো চোখে ভাসে। অবচেতন মনেই আপনার চারপাশের পরিবেশ আপনাকে মনে করিয়ে দেয় অতীতের তিক্ত মধুর অভিজ্ঞতাগুলো। সেক্ষেত্রে কিছুদিনের জন্য কোন মনোরোম জায়গায় ঘুরে আসা, আত্নীয় স্বজনের বাড়ি যাওয়া বা বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে আসা আপনাকে সময়টা অন্য কোনদিকে পার করতে সাহায্য করবে।
৪। পুরনো অভ্যাস বা সৃজনশীল কাজ আবার শুরু করতে পারেন।
বিচ্ছেদের পর আমাদের স্বাভাবিক ঘৃণা আসলে মনের ওপর বাজে প্রভাব ফেলতে পারে। চলে যাওয়া মানুষটি যদি একই ক্যাম্পাসের হয় বা বন্ধুমহল দুজনের একই হয় তাহলে চলতে ফিরতে দেখা হয়ে যেতে পারে প্রায়শই। সেক্ষেত্রে যতটা স্বাভাবিক থাকা যায়, ততই ভাল। আপনি কয়েকটি উপায় অনুসরণ করতে পারেন,
প্রথমত, খুব দ্রুত কিছু মনে করার চেষ্টা করবেন না। আপনাদের আগের সম্পর্ক সিনেমার ব্যাকড্রপের মত সব মনে করার চেষ্টা করা উচিত হবে না। বরং আপনি এখন যে কাজে গিয়েছেন সেটাতে মনোযোগ দিন।
দ্বিতীয়ত, বসার চেষ্টা করুন তার পেছন ঘুরে। এতে তার ক্রিয়াকলাপ আপনার চোখে এতটা পড়বে না বা আপনিও অন্য কিছুতে সহজে ব্যস্ত হতে পারেন।
তৃতীয়ত, যদি দেখার সাথে আবার কথা বলার মত অবস্থা সৃষ্টি হয় তবে খুব ফর্মালিটির সাথে কুশলাদি বিনিময় করতে পারেনা। আপনাকে বিশ্বাস রাখতে হবে, আপনার ধৈর্য খুব ভাল এবং এই দেখা হওয়াটা আপনার অনিচ্ছায়। তাই খুব বেশি কথা না বাড়িয়ে আপনি অন্যের সাথে আলাপ বা খাওয়া দাওয়া বা মোবাইলে ব্যস্ত হতে পারেন। এতে আপনার রাগ নিয়ন্ত্রিত হবে, আপনিও এরকম পরিস্থিতি পার করার ভাল উপায় শিখে যাবেন।
আর যদি আপনি একান্তই চান আপনি আপনার সাবেককে বন্ধুরূপে পেতে তবে ব্যপারটি চ্যালেঞ্জিং হলেও সাধুবাদ পাবার মত। বোঝাই যাচ্ছে, আপনি আর দশজন সাধারণ নন, যে সাবেক কে বকাঝকা করে, অন্যের কাছে দোষ বলে বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় তার অনুপস্থিতে তার নামে আপনার খেয়াল খুশিমত দোষারোপ করে খুশি হয় বা বদভ্যাসে পরিনত করে। এ ক্ষেত্রে সম্পর্ক চলে গেলেও বেঁচে থাকে বন্ধুত্ব। আপনি তার সাথে কথা না বলেও, নিয়মিত যোগাযোগ না রেখেও এমনকি কল বা ফেসবুকে ব্লক না করেও তার সাথে প্রচ্ছন্ন সুস্থ একটি সম্পর্ক রাখতে পারেন যেটি ডাস্টবিনের মত বন্ধুমহলে গন্ধ ছড়াবে না।
আপনি তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারেন, আপনি বিশেষ দিন যেগুলো আপনাদের সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট নয় বা কোন স্মৃতি মনে করিয়ে দেবে না সেদিনে শুভেচ্ছা জানাতে পারেন। তার কোন সাফল্যে অভিনন্দন জানতে পারেন, সেটা হতে পারে তার নতুন সম্পর্ক গড়াতেও। একটা কথা সবসময় মাথায় রাখতে হবে, যে সম্পর্কটি ভেঙে গেছে সেটি একসময় আপনাদের হাতেই গড়া ছিল, পারস্পরিক বিশ্বাস শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় সেই সম্পর্কে আপনার প্রতিটি সময় কেটেছে। আজ সেটা ভেঙে যেতেই পারে, তবে তাতে বদনাম দেয়া বা ঘৃণা ছড়ানো, অন্যের দোষ বলে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখটা বোকামি শুধু হয়, পরোক্ষভাবে নিজেকেই অপমান করারই সমান। তাই বন্ধুত্ব সবসময় একটি দারুন সমাধান হতে পারে আপনার মনকে শান্ত রাখতে। রবীন্দ্রনাথের লেখা দিয়ে শেষ করছি-
"প্রেমে সুখ দুখ ভুলে তবে সুখ পায়।
সখী চলো, গেল নিশি, স্বপন ফুরাল,
মিছে আর কেন বল।
শশী ঘুমের কুহক নিয়ে গেল অস্তাচল।
সখী চলো।
প্রেমের কাহিনী গান, হয়ে গেল অবসান।
এখন কেহ হাসে, কেহ বসে ফেলে অশ্রুজল।"