দুনিয়াতে মেয়েরা সুখে থাকে কম, কষ্ট সহ্য করে বেশি!
- ফারজানা আক্তার
- নভেম্বর ২, ২০২০
কয়েকদিন আগে ডিএসই গ্রুপে এক আপুর পোস্ট দেখেছিলাম। সেদিন আপুর জন্মদিন ছিলো। নিজের জন্মদিন উপলক্ষে আপু একটা সাদা জামদানি কিনেছিলেন। নিজের হাতে কেক বানিয়েছেন। আপুর দুইটা বাচ্চা। আপুর স্বামীর সাথে কিছুটা টানাপোড়ন চলছিল। আপুর ইচ্ছে ছিলো সেদিন তার জন্মদিনে সব টানাপোড়নের অবসান ঘটাবেন। আগের সবকিছু ভুলে দুইজন সুন্দরভাবে আবার শুরু করবেন।
নিজের জন্মদিনে নিজের জন্য আলাদা আয়োজন করলেও বাসায় কাউকে কিছু জানান নি। বাসায় আপু, তার স্বামী আর দুই বাচ্চা থাকে। ছুটির দিন ছিলো মনে হয় সেদিন! আমার ঠিক মনে নেই। হয় ছুটির দিন ছিলো অথবা কোন কারণে আপুর স্বামীর অফিস বন্ধ ছিলো। দুপুরে খেতে বসে আপু আর তার স্বামীর মধ্যে আবার একটা ঝামেলা হয়ে গেলো। গত কয়েক বছর ধরে উনিশ থেকে বিশ হলে আপুর স্বামী তাকে বলেন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিবে, অথবা তার বাসা থেকে তখনই বের হয়ে যেতে।
আরো পড়ুন : অভিভাবক হিসেবে কিছু কাজ যা বাচ্চাদের সামনে করবেন না
সেদিনও সেইম কথাটা বলেন তার স্বামী। অনেক দিনের জমানো অভিমান সেদিন বাঁধ ভাঙলো। আপু চুপচাপ খাওয়া শেষ করে জন্মদিনে পরার জন্য সে সাদা জামদানি কিনেছিলেন সেটা পরলেন। দুই বাচ্চাকে রেডি করলেন। তারপর সোজা বাসা থেকে বের হয়ে আসলেন। আপু বের হওয়ার সময় তার স্বামী শুধু একবার বলেছিলো বাহিরে বের হলে পা ভেঙ্গে দিবো। যে সংসারে প্রতিনিয়ত মন ভাঙে সেখানে পা ভাঙার ভয় তিনি পান নি।
বাসা থেকে তো বের হলেন যাবেন কোথায়! ঢাকায় উনি ৭ বছরের বেশি সময় ধরে থাকেন। আত্মীয় স্বজনের বাসায় তেমন যান নি। যোগাযোগও রাখা হয় নি। বাপের বাসা ঢাকার বাহিরে। বিয়ের পর নিজের অশান্তি বাপের বাড়িতে টেনে নিতেও ইচ্ছে করে না। আপু ভেবে পাচ্ছিলেন না দুই বাচ্চা নিয়ে উনি কোথায় উঠবেন!
আপু উচ্চশিক্ষিত এবং ভালো পরিবারের মেয়ে ও বউ। জব করার ইচ্ছে থাকলেও বিয়ের পর পর মা হয়ে যান তাই সে ইচ্ছে পূরণ হয় নি। তাছাড়া সংসার আপু সামলাচ্ছিলেন, ইনকামের দিক তার স্বামী দেখছিলেন। সংসার দুইজনের।
আরো পড়ুন : জীবনে ঘটে যাওয়া কোন দুর্ঘটনা আপনাকে বারবার আটকে দিচ্ছে ?
একজন ঘর সামলাবে, অন্যজন বাহির। ভালো কথা! এই দুইজনের মধ্যে যিনি ইনকাম করেন মানে কর্তা মশাই যখন তখন তার গিন্নীকে বাসা থেকে করে বের দিতে পারেন? যখন তখন তার ভরপোষণ বন্ধ করে দিতে পারেন? যখন তখন ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার হুমকি দিতে পারেন?
আপু বের হয়ে যাওয়ার পর তার স্বামী একবারো তাকে ফোন দেয় নি। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আপু তার এক মামাকে ফোন দিয়ে তার বাসায় উঠেন। তারপর উনি তার স্বামীর অফিসের বসকে সব জানান। অফিসের বস ফোন দিয়ে তার স্বামীকে সব ঠিক করে নিতে বলেন। তারপর উনার স্বামী ফোন দিয়ে লোকেশন জেনে তাকে নিয়ে আসেন। সাথে বলেন অফিসের বসকে ইনভল্ভ করা ঠিক হয় নি। বিষয়টা আপুও বুঝতে পেরেছেন কিন্ত তিনি নিরুপায় ছিলেন।
এই আপুর কপাল অনেকটা ভালো ইনস্ট্যান্ট তাও কোন একটা সমাধান হয়েছে। আমাদের দেশের এমন অনেক মেয়ে আছেন বাপের বাড়িতে দিনের পর দিন বাচ্চা নিয়ে পরে আছে। স্বামী খোঁজ খবরও নেয় না, বউয়ের দায়িত্ব বাদ থাকুক বাচ্চাদের দায়িত্বও নেয় না।
আরো পড়ুন : ছেলেটা জানতে চাইলো এই অবস্থায় সে সুইসাইড করলে পাপ হবে কিনা!
অনেক মেয়েরা আছে পড়াশোনা করে নি, অনেকে পড়াশোনা করেছেন কিন্ত সংসার সামলাতে গিয়ে নিজে কিছু করেন নি। সংসারকে আপন করে নিয়ে নিজের পুরো জীবন, নিজের সাধ আহ্লাদ সংসারে দিয়েছেন, এক সময় এই সংসার তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
বিয়ের সময় মেয়ের বাবা মেয়ের সব দায়িত্ব একজন ছেলের হাতে তুলে দেয়। তারপর ছেলেটি হয়ে যায় মেয়ের স্বামী। নিজের বউয়ের সকল দায় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নতুন জীবন শুরু হয়। যে বউয়েরা বিয়ের পর পড়াশোনা করতে চায় তাদের অনেককে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়, অনেকে চাকরি করে সেটা ছেড়ে দিতে হয়।
স্বামীর কথা তিনি তো ইনকাম করছেন, আপনি সংসার সামলান। স্বামীর কথা শুনে বৌয়েরা আহ্লাদে আহ্লাদী হয়ে সংসারে মনযোগ দেয়। সেই স্বামী হুট্ করে তাকে বাসা থেকে বের করে দিবে, অথবা অন্য কোথাও বিয়ে করে ফেলবে, অথবা ভরণপোষণ বন্ধ করে দিবে অথবা সেই বউয়ের জীবন তছনছ করে দিবে! অবিশ্বাস্য হলেও আমাদের দেশে এখনো বেশিরভাগ মেয়ের জীবনের চিত্র এমনটাই।
আরো পড়ুন : গবেষণা বলছে, শৈশবে শাসন করা মায়ের সন্তানদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়!
এই যে স্বামীর উপর ভরসা, বিশ্বাস রেখে মেয়েরা নিজের স্বপ্ন, ক্যারিয়ার সব জলাঞ্জলি দিয়ে পুরো সংসারী হয়ে উঠে দিনশেষে তাদের কপালে কী জুটে ? অনেক মেয়ের বাবা মা বেঁচে থাকে না। ভাইয়ের সংসারে জায়গা হয় না। অনেকের বাবা মায়ের সামর্থ্য থাকে না এবং আরো অনেক কিছু। এমন অপ্রত্যাশিত ঝড়ে সেসব মেয়েদের জীবন কেমন হয় ভাবতে পারেন?
এই সমাজের বেশিরভাগ মানুষ মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার বিপক্ষে। আপনারা একবারো ভেবে দেখেছেন এই যে উচ্চ শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত , নিরক্ষর মেয়েরা স্বাবলম্বী না হয়ে পুরো সংসারী হয়ে যখন এমন বিপদে পড়ে তখন তাদের অবস্থা কী হয়?
ওহ! কাদের কি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছি। সংসার না টিকলেও তো মেয়েদের দোষ। স্বামী চরিত্রহীন, মেয়ের দোষ! স্বামী লোভী, মেয়ের দোষ! স্বামী অমানুষ, মেয়ের দোষ! আমার পক্ষে যদি সম্ভব হতো না আমি সব মেয়েকে হাতে ধরে ধরে বলতাম খুব সামান্য কিছু হলেও আপনি কাজ করুন। ১০০ টাকা হলেও ইনকাম করতে শিখুন। ১০ টাকা হলেও নিজের জন্য আলাদা সঞ্চয় করুন।
মানলাম আপনার স্বামী খুব ভালো। আপনার স্বামী আপনাকে ছেড়ে কখনো যাবে না। বৃদ্ধ বয়সের কথা ভেবে হলেও নিজের জন্য আলাদা কিছু করুন। একটা সময় পেটের ছেলে মেয়েও তো পর হয়ে যায়। জীবন বড় কঠিন, বাস্তবতা অনেক নিষ্ঠুর।
আরো পড়ুন : শিশুর অগোছালো ঘর গুছিয়ে রাখার সহজ কৌশল
এই দুনিয়ায় মেয়েদের এতো বেশি দোষী সাব্যস্ত করা হয়, জানি না পরকালের জন্য আর কিছু বাকি আছে কিনা! জীবনে যত ধরণের সমস্যার মোকাবেলা আমরা সকলে করি, তার মধ্যে সংসারের সমস্যা সবথেকে বড় সমস্যা। এবং মেয়েরাই এই সমস্যার সবথেকে বড় ভিকটিম।
বিয়ে হচ্ছে না কেন! মেয়ের দোষ। বাচ্চা হচ্ছে না কেন! মেয়ের দোষ। সংসার টিকে নি কেন! মেয়ের দোষ। স্বামী আরেক বিয়ে করলো কেন! মেয়ের দোষ এবং টু বি কন্টিনিউ...
হে আল্লাহ! মেয়েদের তুমি অনেক সহনশীল করে বানিয়েছো। দুনিয়াতে তারা সুখে থাকে কম, সহ্য করে বেশি। পরকালে তুমি তাদের একটু বেশিই ভালো রেখো।