
হে বেশিরভাগ পুরুষেরা! আপনাদের কিসের এতো ভয়?
- ফারজানা আক্তার
- ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২১
কয়েকদিন আগের কথা! গ্রামে গিয়েছি। গ্রাম সম্পর্কিত এক কাকা জানতে চাইলো আমার বোনের বিয়ে হয়েছে কিনা! আমি তাকে উত্তর দিলাম বোন এখন বিয়ে করতে রাজি নয়। নিজের ক্যারিয়ার ঠিক করে বিয়ে করবে। কাকা উদাসী হয়ে উত্তর দিলো, 'মাইয়া মানুষ বেশি পড়াশোনা কইরা চাকরি বাকরি করলে উপযুক্ত পোলা পাওয়া যায় না। '
এই উপযুক্ত বলতে উনি বুঝিয়েছেন আমার বোন অর্নাস পাস হলে বোনের বরকে মাস্টার্স পাস হতে হবে। বোনের বেতন ২০ হাজার টাকা হলে বোনের বরের বেতন মিনিমাম ২৫ / ৩০ হাজার হতে হবে। তো এই দেশে কি উপযুক্ত ছেলে নেই ? লাখে লাখে আছে। সমস্যা আসলে উপযুক্ত ছেলেতে নয়, সমস্যা শিক্ষিত মেয়েতে!
সেদিন পরিচিত এক মেয়ে বলছিলো সে ডাবল মাস্টার্স করতে চায় কিন্তু পরিবার করতে দিচ্ছে না। কারণ ডাবল মাস্টার্স করা মেয়ের জন্য এই দেশে নাকি উপযুক্ত পাত্র নেই। এই দেশের ছেলেরা পড়াশোনা করে না ? এই দেশে মেধাবী ছেলে নেই ? তাহলে একজন ডাবল মাস্টার্স করা মেয়ে বা স্মার্ট স্যালারি পাওয়া মেয়ের জন্য এই দেশে উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাবে না কেন?পরিচিত বেশ কিছু লেখিকা আছেন। খুবই ভালো লিখেন। ফেসবুকের কল্যাণে খুব দ্রুত পাঠকের কাছে পৌঁছেছেন। পাত্রপক্ষ আসেন, দেখা করেন, পছন্দ করেন। সবই ঠিক আছে।
কিন্তু পাত্রীর লেখালেখির জন্য পাত্রীর জনপ্রিয়তা অনেক। এই জনপ্রিয়তার কারণে পাত্রপক্ষ মনে করেন যোগ্যতার দিক থেকে পাত্রী পাত্রের থেকে অনেক এগিয়ে আছেন। তাই তারা এই পাত্রীর সাথে তাদের ছেলের বিয়ে দিবেন না। এভাবে বিয়ে আসে আর যায়!
আল্লাহকে বিশ্বাস করি এবং ভাগ্যেও বিশ্বাস করি। যদি ধর্মের কথা টানি তাহলে বলতে হয় কপালে যখন তাদের বিয়ে লেখা আছে তখনই হবে।
আমরা ধর্ম এবং সমাজ দুটো নিয়েও বাঁচি। যদি সামাজিকতার কথা বলি তাহলে কী দাঁড়ালো ? এই সমাজের বেশিরভাগ মানুষ ইনসিকিউরিটিতে ভুগে।
বহু বছর ধরে এই সমাজকে পুরুষরা শাসন করে আসছে। অতীতে ছেলেরা টাকা ইনকাম করতো, আর মেয়েরা ঘর সামলাতো। যে টাকা ইনকাম করে পরিবার এবং পরিবারের সকলের বিষয়ে সে একা সিদ্ধান্ত নিবে। নিয়ম এমনটাই ছিলো। যে টাকা ইনকাম করে তার সব সিদ্ধান্ত সঠিক হবে বিষয়টা এমন নয়! কিন্ত তখনকার নিয়ম ছিলো যে টাকা ইনকাম করবে সে বাকি সবাইকে ডমিনেট করবে। তাতে কে কষ্ট পেলো, কে দুঃখ পেলো, কার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো এসব দেখার সময় নেই।
যেহেতু মেয়েরা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ছিলো না তাই শত অত্যাচারেও ঘর থেকে বাহিরে পা রাখার সাহস করতো না। আর এই সুযোগটাই বেশিরভাগ পুরুষ মানুষ নিতো। পরিবারের ছেলে সদস্যরা এই মন মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। তারা ভাবে তারা পরিবারের কর্তা আর মেয়েরা তাদের হাতের পুতুল। তারা দুই টাকা / পাঁচ টাকা ইনকাম করে ঘরে এসে লাখ টাকার বদমায়েশি করবে।
ধীরে ধীরে সময় বদলাতে থাকে। মেয়েরা শিক্ষিত হতে শুরু করে। নিজের আত্মসম্মান সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। স্বাবলম্বী হচ্ছে। একজন আত্মসম্মানবোধ সম্পূর্ণ নারীকে চাইলেই পুতুল নাচ নাচানো যাচ্ছে না। একজন লেখাপড়া জানা মেয়ের গায়ে চাইলেই হাত তোলা যায় না। একজন স্বাবলম্বী মেয়েকে চাইলেই যখন তখন খাওয়ার খোঁটা দেওয়া যাচ্ছে না। একজন সু শিক্ষিত মেয়ের সাথে অন্যায় করে পারও পাওয়া যায় না।
যখনই এমন কিছু পজেটিভ পরিবর্তনের হাওয়া চারপাশে লাগতে শুরু করলো ঠিক তখনই কিছু পুরুষের পিলে চমকে উঠলো। তারা ইনসিকিউরিটিতে ভুগতে শুরু করলো। তারা ভাবলে লাগলো এই বুঝি তাদের কর্তাগিরি হাত থেকে ফস্কে গেলো! যেমন ভাবে তারা মেয়েদের ডমিনেট করতো, মেয়েরাও হয়তো এখন তাদের সেভাবে ডমিনেট করবে! কিন্তু বিষয়টা যে পজেটিভও হতে পারে সেটা ভাবছে না।
একজন মাস্টার্স পাস করা ছেলে গ্রামে গিয়ে সিক্স / সেভেনে পড়া মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতে বাচ্চা নিয়ে নেয়। গ্রামে মা আর বাচ্চাকে পুতুল খেলতে দিয়ে তিনি ঢাকা শহরে এসে গায়ে হাওয়া লেগে ঘুরে বেড়ান।
আগে মেয়েরা পড়াশোনা জানতো না, স্বাবলম্বীও ছিলো না। তখনো অত্যাচার সহ্য করতো। তখন শারীরিক অত্যাচার বেশি ছিলো। এখন মেয়েরা পড়াশোনা করে, স্বাবলম্বী হচ্ছে। এখনো মেয়েরা অত্যাচারিত হচ্ছে। এখন মানসিক অত্যাচার বেশি।
হে বেশিরভাগ পুরুষেরা! আপনাদের কিসের এতো ভয়? নিজে শিক্ষিত হয়ে একজন শিক্ষিত নারীকে ভয় পান। আপনি কেমন শিক্ষায় শিক্ষিত হলেন? নিজে উচ্চশিক্ষিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে উঁচু গলায় বলেন 'বাল্য বিবাহ বন্ধ হোক'! আর, গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে লজ্জা করে না?
কেমন যোগ্যতা সম্পূর্ণ পুরুষ মানুষ আপনি! একজন যোগ্যতা সম্পূর্ণ নারীর পাশে হাঁটার সাহসটুকুই আপনার নেই। শুধুমাত্র শারীরিকভাবে পুরুষ হয়ে নিজেকে পুরুষ প্রমান করতে আসবেন না। সেখানে আপনার কোন কৃতিত্ব নেই। পুরুষ শব্দটার মধ্যে যে দাম্ভিকতা আছে সেটা কাজে প্রমান করুন। পুরুষ মানুষ হয়ে যদি এতো ইনসিকিউরিটিতে ভুগেন তাহলে পরবর্তীতে নিজেকে আর পুরুষ মানুষ বলে পরিচয় দিয়েন না। 'পুরুষ' শব্দটা লজ্জা পাবে।