`সাইকো`
- সুমনা বাগচী
- ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২১
মানুষের মন এক অদ্ভুত চিন্তার জালে আবদ্ধ। মনের সুক্ষ্ণ ভাবনা ও চিন্তা গুলোর সমন্বয়ে ব্যবহারের পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু অদ্ভুত ভাবনার ঘেরাটোপে আচরণ গুলো অদ্ভুত ভাবে প্রকাশ পায়। আজ তেমনই একটা গল্প বলবো, যার কোনো বিশ্লেষণ করা কঠিন। মনের বিভিন্ন স্তরের ভাবনা গুলোর নাম দেই আমরা, হ্যালুসিনেশন, ডিলিউশন, ইলিউশন। কিন্তু বাস্তব তার থেকেও অন্য রকম প্রকাশ আনে।
তাই মন মানে না কোনো বিজ্ঞান সম্মত ভাবনার উপর ভিত্তি করে। এইরকম একটি ঘটনার শিকার একটি মেয়ে। ছোটো থেকেই একান্ন বর্তী পরিবারের সদস্য সে। তাই সবার মাঝে ও একসাথে বেড়ে ওঠার মধ্যে ভালো মন্দ দুই দিক প্রকাশ পায়। ছোটো থেকেই সে গল্প লিখতে বেশ ভালোবাসতো।নানান ভাবনা ও কল্পনার জালে তার লেখা এক অন্য মাত্রা পেতো। কিন্তু কোনদিন তার এই লেখার একটি গল্পও সে তার পরিবার কিংবা বন্ধু বান্ধব কে দেখাতো না। খুব যত্ন করে সেই ডাইরি টি সে লুকিয়ে রাখতো একটা গোপন স্থানে। বয়স তখন তার দশ হবে। আর সেদিন জন্ম দিন উপলক্ষে বাড়িতে অনেক লোকের আনাগোনা।
আরো পড়ুনঃ সুস্থ ত্বকের যাবতীয় সত্য-মিথ্যা
মেয়েটি খুব আনন্দে আছে। অনেক উপহার আর জমজমাট অনুষ্ঠানে সে সত্যি খুব খুশি। বরাবর একটু শান্ত স্বভাবের হলেও জন্মদিনের দিন তাকে বেশ হাসি খুশি লাগছে। আর বিষয় টি তার বাবা মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য দের চোখে পড়লো। বেশ আনন্দ করেই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলো। কেক কাটা,লুচি মাংস,পায়েস, আলুর দম, ফিস ফ্রাই মিষ্টি আর নানান পদে সবাই তৃপ্ত হলো। মেয়েটির মা সেদিন এমনিতেই খুব ব্যস্ত। তাই অতিথি কে স্বাগত জানানো,আর ব্যস্ততা মিলে তিনি সারাক্ষণ কাজ করছেন।
মেয়ের পাওয়া উপহার গুলো রাখার জন্য তিনি তাঁদের ঘরে এলেন। সাথে মেয়েটির বাবাও এলেন।তাঁদের আলনার নিচে একটা বক্সের মধ্যে উপহার গুলো রাখতে গেলেন। সেখানেই তাঁদের মেয়ের অনেক খেলনা আর পুতুল আছে। গুছিয়ে রাখতে রাখতে সেই ডাইরি টা তাঁদের চোখে পড়লো। লাল মলাটে তাঁদের কন্যার অতি যত্নে লুকিয়ে রাখা ডাইরি। কৌতূহল বশত তার মা ডাইরি খুলতে গিয়ে দেখলেন,সেখানে অনেক ছেলে মেয়ের কথা লেখা। অত স্পষ্ট ভাবে লেখা না হলেও বোঝা গেলো,কোনো বিশেষ বিষয়ে বার বার লেখা আছে।
আরো পড়ুনঃ এইডস আক্রান্ত রোগীদের জন্য সুসংবাদ
আজ তুমি কত কথা বললে, জানো আমার দিদি রোজ আসে কথা বলতে,তোমরাও কিন্তু রোজ দেখা করবে আমার সাথে আরেক পাতায় লেখা, আমার মনে হয় ছোটো কাকু কে ছুরি দিয়ে হাত কেটে দিতে, দিদি বলেছে সুযোগ পেলেই তার কেটে দেবে মা বাবা হতবাক। একি দেখছেন? তাঁদের বড়ো কন্যা ছোটো কন্যার জন্মের আগে মারা যায়। আর সেই বিষয় টা সম্পূর্ণ গোপন রাখা আছে। আর বড়ো কন্যা মাত্র সাত মাসে মারা যায়। আর এখানে যাদের নাম লেখা, তাদের ছোটো মেয়ের সাথে পরিচয় হবার কথা না। কারণ তারা নানা রকম ভাবে মারা গেছে। কেউ অসুখে কেউ অ্যাকসিডেন্ট করে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন মা।
এই বিষয় গুলো কি হচ্ছে? কখন আসে কি কথা বলে? কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না তাঁরা। সেদিন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শেষ হবার পর, ক্লান্ত মেয়ে টি ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু মা বাবা সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। যে করেই হোক জানতে হবে আসল সমস্যা কি? পরের দিন সকালে মা কাছে ডেকে তাকে ডাইরির কথা বিষয়ে জানতে চান। প্রথমে চুপ থাকলেও পরে মেয়ে টি বলে, সে তার দিদি আর অনেক বাচ্চাদের দেখতে পায়,কথা বলে। মা বললেন," এটা কি করে সম্ভব হবে? তারা তো কেউ জীবিত নেই"? মেয়ে টি ফুঁপিয়ে উঠে বলে,"না তুমি মিথ্যা বলছো। তারা সবাই আছে। এই তো এই ঘরেই দিদি আছে। তার পাশে তুহিন দাদা"। মা বাবা অস্থির হয়ে মনোবিদের সাহায্য নেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেনো সমস্যার সমাধান করা যায় না। সে এখন ঘরে নিজে নিজে হাসে,কথা বলে।সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।
আরো পড়ুনঃ অগ্নিকাণ্ড থেকে বাঁচতে কী করবেন?
এই ভাবেই সবাই বাচ্চা টিকে 'মনোরোগী' বলে আখ্যা দিয়ে শুরু করে। সমাজ বাচ্চা টি কে নিয়ে নানান কথা বলে, বলে সে নাকি ভূত দেখতে পায়, সে পাগল আরো কত কি? এরপর এক দীর্ঘ সময় ধরে তার চিকিৎসা করা হয়। অনেক ভাবে ও মনো বিজ্ঞানের সাহায্যে জানা যায়, ছোটো বেলায় বাড়ির অনেকের কাছে সে তার দিদির মারা যাওয়া, আর পাড়ার অনেকের কথা জানতে পারে। এরপর জানা যায়, পরিবারের কারুর থেকে অর্থাৎ আপন কাকার কাছ থেকে সে শারীরিক ভাবে অত্যাচারিত হয়। তখন ভয়ে আর কাকার ব্যবহারে সে নিজেই তার অদেখা অজানা মানুষ দের সাথে কথা বলতে শুরু করে। এইভাবে নিরাপত্তা আর ট্রমা থেকে বেরোনোর জন্য সে বাস্তব থেকে দূরে গিয়ে,কিছু কল্পনায় আসা মানুষদের সাথে কথা বলতে শুরু করে। কারণ সে ভয় পায়, নিজেদের লোকেদের বিশ্বাস করতে।
আর সেই জন্য কল্পনায় আসা চরিত্র গুলো তার কাছে বাস্তব। তারাই বন্ধু আর তারাই তার বাঁচার উপায়। একটা বাস্তব গল্প। একটি শিশু এভাবেই বাধ্য হয়ে ভয় পেয়ে নিজের জগৎ তৈরি করে, যা সম্পূর্ণ কাল্পনিক আর ভিত্তি হীন। কিন্তু এতে তার শান্তি।এটা অবশ্যই একধরনের ডিফেন্স মেকানিজম। আজ মেয়েটি বড়ো হয়েছে। সমাজের সকল বাধা থেকে বেরিয়ে এগিয়েছে সামনের দিকে। পিছনের কথা আর ঘটনা অস্পষ্ট হলেও সে নতুন ভাবে বাস্তব কে আপন করেছে তার কাছের মানুষদের সহযোগিতায়। সমাজ তাকে সাইকো বলে আখ্যা দেয়। কিন্তু সমাজ তার মন বোঝে না। আর এভাবেই আমরা নিজেদের এই অস্তিত্বের লড়াই থেকে মুক্তি পাবার উদ্দেশ্যে একটা অবাস্তব জীবন কে আপন করি। ভেবে দেখুন তো কারা দায়ী,এই সাইকো কথাটির জন্য? ভেবে দেখুন। নয় তো দেরি হয়ে যাবে।