বন্ধুত্ব কেন ভাঙে?
- জান্নাতুন নুর দিশা
- জানুয়ারি ৫, ২০১৯
কয়েকদিন আগে এক জুনিয়র আফসোস করে বলছিলো "আপু, আমাদের একটা দারুণ ফ্রেন্ড গ্রুপ ছিলো। একসাথে ঘুরতাম, আড্ডা দিতাম, মজা করতাম। পুরো ক্যাম্পাস আমাদের ফ্রেন্ডশিপ দেখে অবাক হয়ে যেতো, জেলাস হতো। কিন্তু সময়ের সাথে এখন এমন অবস্থা এ ওর মুখ পর্যন্ত দেখতে চায় না, গ্রুপ ভেঙে চৌদ্দ টুকরো।"
তার এই আফসোসের জায়গাটা ভাবিয়েছে বেশ। আসলেই অধিকাংশ ফ্রেন্ডগ্রুপ আজকাল বেশিদিন সারভাইভ করে না। কয়েক বছর যেতেই ভেঙে যায়। আগেকার যুগে বন্ধুত্বগুলো ছিলো মান্না দে'র কফি হাউজের মত। সময় গড়ালে দূরত্ব বাড়তো ঠিকই, থেকে যেতো হৃদ্যতা, আন্তরিকতা, মানসিক অনুভব।কিন্তু আজকাল বন্ধুত্বগুলো ভাঙে খুব নোংরাভাবে। ঝগড়া, বিদ্বেষ আর ভুল বুঝাবুঝি নিয়ে ভাঙে অধিকাংশ বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব নামক সুন্দর, সহজ ও নির্ভরতার সম্পর্কটিকে আমরা ক্রমশ বানিয়ে ফেলছি জটিল থেকে জটিলতর।
কেন ভাঙে আজকাল এভাবে বন্ধুত্ব? প্রথম সমস্যা ইগো সমস্যা। একালের তরুণদের রয়েছে অনর্থক অপ্রয়োজনীয় ইগো। একে অন্যের কথাকে মেনে না নেয়ার প্রবণতা। সহজেই রাগ করে বসা। বন্ধুত্বকে বুঝতে না চাওয়া। বেশিরভাগ বন্ধুত্বে আজকাল ভাঙন ঘটে ইগো প্রবলেম থেকে, কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না, বাড়ে মানসিক দূরত্ব।
দ্বিতীয় কারণ উপগ্রুপ তৈরি। একটা ফ্রেন্ড গ্রুপে উপগ্রুপ তৈরি খুব খারাপ ব্যাপার। শুধু ফ্রেন্ডগ্রুপে না, যেকোনো অংশীদারি কাজে এটা খুব ক্ষতিকারক। উপগ্রুপের অধিক হৃদ্যতা, আলাদাভাবে নিজেদের মূল্যায়ন পুরো গ্রুপের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও ভুল বুঝাবুঝি তৈরি করে। শুরু হয় প্রায়োরিটি লিস্ট তৈরি, মানসিক দূরত্ব এবং ভাঙনের সূচনা।
ঈর্ষাকাতরতা আরেকটা বড় সমস্যা সম্পর্কগুলোতে। বন্ধুগ্রুপে কেউ একজন এগিয়ে গেলে অন্যদের চেয়ে বাকিদের এতে আনন্দিত হবার কথা। তা না হয়ে যদি কেউ কেউ ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে, তবে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় বন্ধুত্বের বোঝাপড়ার জায়গা। বন্ধুর সাফল্য নিজের সাফল্য মনে করতে না পারা অত্যন্ত ছোট মানসিকতার পরিচয়।
বন্ধুর ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং নিজের ইচ্ছাধীন চালাতে চায় অনেকে হয়ে উঠে স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের। বন্ধু কোথায় যাবে, কার সাথে মিশবে, কী খাবে, কী পরবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্বসুলভ মনোভাব প্রায়শই তৈরি করে বিরূপতা। আবার বন্ধুর প্রেমিক/প্রেমিকা বা অন্য কোনো কাছের বন্ধুকে মানতে না পারাও প্রায় সময় ভাঙন ঘটায় বন্ধুত্বে। বন্ধুর ব্যক্তি জীবনে হস্তক্ষেপ না করতে চাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। মনে রাখতে হবে আপনি বন্ধু, অভিভাবক নন।
বন্ধুগ্রুপে একজন ব্যতিক্রম মানসিকতার প্রবলেমেটিক সদস্য ঢুকে গিয়ে ভেঙে দিতে পারে পুরো গ্রুপ। এর নামে ওকে, ওর নামে একে ভুলভাল বুঝিয়ে তৈরি করে দেয় মহাঝামেলা। কান কথায় কান দেয়া এবং অন্যের কথায় দ্রুত প্রভাবিত হয়ে বন্ধুজনকে ভুল বুঝে বসা মূলত অপরিপক্বতা।বন্ধু গ্রুপে কারো নেতৃত্বের মনোভাব থাকা খুবই নেতিবাচক মানসিকতা। বন্ধুগ্রুপে কেউই কখনো অন্য সবাইকে ছাপিয়ে নেতা হয়ে উঠতে চাওয়া ঠিক না। বন্ধুত্ব মানেই সমতা। নিজের ইচ্ছেমত ডিসিশন নিতে না চেয়ে সবার মধ্যে সমান বোঝাপড়া থাকা খুব জরুরী।
সর্বোপরি সকলের প্রতি সকলের সমান ভালোবাসা, যত্ন, নির্ভরতা ও সাপোর্ট থাকলেই টিকে থাকতে পারে একটি সুন্দর সার্কেল। কোনো দুজনের সমস্যা হলে বাকিরা তা নিয়ে জড়িয়ে না গিয়ে মিটিয়ে দেয়া উচিত। সবার প্রতি সমান প্রায়োরিটি দিতে পারা ও ইগো প্রবলেম মুক্ত থাকা একটা বন্ধুগ্রুপকে রাখতে পারে পরিচ্ছন্ন ও দীর্ঘমেয়াদি। সুন্দর হোক প্রতিটি বন্ধুত্ব।