মেয়েদের জীবনটা এমন কেন গো, মা?

  • ফারজানা আক্তার 
  • জুন ৪, ২০২০

' বুঝলি খালেকের বাপ! মাইনষের চরিত্র বুঝা বেবাক কঠিন! মাতার চুল কালা থাইকা সাদা ওইলো, কিন্ত এহনো মানুষ চিনবার পারলাম না।'

উঠানের উত্তরপাশে বরই গাছের নিচে বসে জব্বার আর খালেকের বাপ সুখ দুঃখের কথা বলছিলো। জব্বার আর খালেকের বাপ পাড়াতো ভাই। দুইজন সমবয়সী। ছোটবেলা থেকে একইসাথে বড় হয়েছে। দুইজনে একইসাথে নানান মানুষের ক্ষেতে কামলা যায়।

দুইজনের ঘরে নিত্য দিন অভাব লেগে থাকে। জব্বারের ৪ মেয়ে আর ৪ ছেলে। ছেলেরা বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছে, কিন্তু জামাইদের আব্দার নিত্যদিন লেগে আছে।

আজকে বড় জামাই টাকা চায়, কালকে মেজো জামাই মোটরসাইকেল চায়, পরশু সেজো জামাই বিদেশ যাওয়ার টাকা চায়, ছোট জামাইটা ভালো আছে। এখনো কিছু চায় নি। দুই বছর হইলো ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। এখন পর্যন্ত একটা সুতাও চায় নাই।

' কই গো! শুনছি নি? কয়ডা মুড়ি দিয়া যাও তো! মুড়ি খাইয়া একটু হাটের দিকে যামু।' জব্বার হাঁক দিয়ে তার বউকে কথাগুলো বললো।

' এই সময় হাঁটে কেন যাইবা? কোন কাম আছে নি?' খালেকের বাপ জব্বারকে জিজ্ঞেস করে।

' ছোট মাইয়াটারে দেখবার মন চাইতাছে। হাঁটে যাইয়া দেহি বড় মাছ পাই কিনা! মাইয়াটা বড় মাছের মাথা খাইতে পছন্দ করে। বড় মাছ পাইলে কিন্না মাইয়াটারে দেইখা আসমু।'

জব্বারের বউ এক বোল মুড়ি, পেঁয়াজ আর তেল মাখিয়ে দিয়ে যায়। জব্বার আর খালেকের বাপ সেই মাখানো মুড়ি খাচ্ছে, আর নানান বিষয়ে গল্প করছে।

হুট করে জব্বার দেখে তার ছোট মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জব্বার মেয়েকে দেখে মুখে মুড়ি নিয়ে চমকে উঠে দাঁড়ায়। মেয়ের কপাল ফোলা, গালে কাটা দাগ, মাথার চুল এলোমেলো, চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে।

জব্বার মুখের শক্ত মুড়ি গিলে ফেলে। কোনরকমে জিজ্ঞেস করে, ' মা'রে! কি হয়েছে? '

মেয়ে চিৎকার দিয়ে জব্বারকে জড়িয়ে ধরে। কোন রকমে কান্না সামলিয়ে বলে, ' তোমাগো জামাই কইছে একটা মোটরসাইকেল আর লাখ খানেক টাকা ক্যাশ নিয়া যাইতে। এসব নিতে না পারলে এই বাড়িতেই থাইকা যাইতে।'

জব্বার কোন রকমে ঢেকুর তুলে বলে, ' তাগো তো কোন দাবি আছিলো না। এহন দাবি আইলো কেন? আর, কিছু লাগলে কইবো তোরে মারলো কেন?ঃ

মেয়ে বললো, ' আমি কইছি বিয়ার সময় কিছু দাবি করেন নাই। এহন দাবি করেন কেন? আমার বাপ গরীব মানুষ। এতো কিছু দিবার পারবো না। '

খালেকের বাপ পাশ থেকে বলে, ' কি পাষন্ড জামাই! এই কতার লাইগা কেউ এভাবে পিডায়?'

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে জব্বারের বউ ঘর থেকে বের হয়ে আসে। মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না লুকায়।

তারপর নিজ স্বামীর কাছে গিয়ে বলে, ' মনে পড়ে ময়নার বাপ? মাত্র ৮০ হাজার টাহার লাইগা তুমি মাইরা আমারে বেহুশ বানাইছিলা। আমার বাপ তার একমাত্র সম্বল দুইটা গাভী বেইঁচা তোমারে ৮০ হাজার টাহা দিছিলো। তুমি এহন কি বেঁইচা তোমার মাইয়ার জামাইরে টাহা দিবা?'

জব্বারের বউ মেয়েকে নিয়ে ঘরে যেতে যেতে বললো, ' তোর বাপের অবস্থা দেখে শান্তি লাগছে। কিন্তু তোর অবস্থা দেখে মা কলিজা ফাইট্টা যাইতাছে। মাইয়া গো জীবনডা এমন কেন গো, মা?

যে বয়সে স্বামীর সোহাগ পাওয়ার কতা, সেই বয়সে খাইছি স্বামীর হাতের মাইর। আমি মাইরের ব্যথায় কান্দি, আর আমার বাপে কানছে আমার ব্যথায়।

এই বয়সে তোর বাপের কান্দন দেইখা ভাবলাম আমি একটু হাসমু, কিন্তু তোর কান্দনে কলিজা ফাইট্রা যাইতাছে।

এই একটা জীবনে মন খুইল্লা হাসবার পারলাম না গো, মা! হাসবার পারলাম না!'

#হাসি
#গল্প

Leave a Comment