সুখীপুরের জামাল কামাল
- ফারজানা আক্তার
- জুন ১৮, ২০২০
' রবিনরা সব ইয়া বড় বড় কই মাছ দরতাছে। আয় আমরাও যাই। ' দুই হাত দুই পাশে ছড়িয়ে বোয়াল মাছের সাইজ দেখিয়ে কামাল জামালকে কথাটা বললো।
'হাছা কইতাছত? এতো বড় কই মাছ হয়?' জামাল নাক টানতে টানতে চোখ বড় বড় করে কামালকে জিজ্ঞেস করলো।
জামাল আর কামাল দুইজন আপন ভাই। ১ বছরের বড় ছোট দুইজন। সারাক্ষণ একসাথে আঠার মতো লেগে থাকে। এরা কখন মারামারি করে, কখন ভালো থাকে কিচ্ছু বুঝা যায় না।
একটু আগে দুই ভাই মারামারি করছিলো। কামাল জামালের পিঠে দুইটা দুপদাপ কিল মেরে পালিয়ে যায়। কিল খেয়ে জামাল কামালকে গালাগাল দিচ্ছিলো।
গালি শুনে তাদের মা এসে জামালকে আরো কয়েকটা কিল দিয়ে গেলো। মা ভাইয়ের কিল খেয়ে এতক্ষণ জামাল কাঁদছিলো। যেই কামাল এসে কই মাছের কথা বললো ওমনি ব্যথা, কান্না দূর হয়ে গেলো।
দুই ভাই এক দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির পাশের নিচু জমিতে যেখানে সবাই মাছ ধরছে সেখানে চলে গেলো। কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। নিচু জমিতে পানি আটকে আছে।
জমির পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে ছোট্ট একটি নদী বয়ে গেছে। বৃষ্টি বাদলার দিনে এই নদী থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে কই মাছ, টাকি মাছ উঠে আসে। জমির পানিতে নদী থেকে উঠে আসা মাছেরা আশ্রয় নিয়েছে।
কিছুক্ষন আগে উত্তর পাড়ার মোখলেস সেই জমির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আছাড় খেয়ে পড়ে যায়। জমির পানিতে হাত পা ধুইতে গিয়ে দেখে কই মাছ গাঁই মারছে। সাথে সাথে মোখলেস পাড়ার সব বন্ধুদের ডেকে এনে সেই জমিতে মাছ ধরতে লেগে যায়।
জামাল আর কামাল দৌঁড়ে গিয়ে তাদের সাথে মাছ ধরায় যোগ দেয়। হই হুল্লোড় করে সবাই একসাথে মাছ ধরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ছোট্ট এই গ্রামের নাম সুখীপুর। গ্রামের নাম হওয়া উচিত ছিলো অভাবপুর। জামাল আর কামাল প্রায়ই নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে এই গ্রামের নাম যে বা যারা সুখীপুর রেখেছে তাদের মাথায় একটুও বুদ্ধি ছিলো না। যে গ্রামের মানুষ দুইবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারে না সেই গ্রামের নাম সুখীপুর হয় কি করে!
এমনি বারো মাস এই গ্রামে অভাব লেগে থাকে। এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কুলির কাজ করে। কুলির কাজ করে সবাই কোন রকমে দিন পার করছিলো। দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার পর সবাই ঘরে বসে। কারো কোন কাজ নেই।
লকডাউনে যানবাহন সব বন্ধ ছিলো। সবাই ভেবেছিলো লকডাউন খুলে দিলে তাদের দিন কিছুটা হলেও ফিরবে। কিন্তু লকডাউনের পর দেখা যাচ্ছে মানুষজন ভাইরাসের ভয়ে নিজেদের মালপত্র নিজেরাই টানে । কুলিদের কেউ ডাকে না।
জামাল কামালরা গত দেড় মাস ধরে এক বেলা ভাত খাচ্ছে। শাক লতাপাতা সিদ্ধ আর ভাত। তাও প্লেট ভরা ভাত কারো ভাগ্যে জুটছে না। ভাত কম, লতাপাতা সিদ্ধ বেশি। বাকি সময় দুই ভাই মারামারি, গল্প, আড্ডা করে সময় পার করে দিচ্ছে। এই গ্রামে লতাপাতা, শাক, রাস্তার ধারের কচু পাওয়াও কঠিন। সবার অবস্থা যে এক!
জামাল আর কামাল দুই ভাই মিলে মোট ৪টি কই মাছ, ৩ টি টাকি মাছ আর কয়েকটা চুনোপুঁটি ধরেছে। দুই ভাইয়ের আনন্দ আর ধরে না।
মেলাদিন পর আজকে দুইভাই মাছ দিয়ে ভাত খাবে। বাড়ি আসতে আসতে দুই ভাই ঠিক করলো আজকে মাকে বলবে প্লেট ভরে ভাত দিতে। চুনোপুঁটি ভাজি করে দিতে, আর বেশি করে ঝোল দিয়ে কই মাছ রান্না করে দিতে।
বাড়ি এসে দুই ভাই গলা ছেড়ে মাকে ডাকলো। দুই ছেলের এমন গলা ছেড়ে ডাক শুনে তাদের মা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হইলো। মায়ের সামনে মাছগুলো দিয়ে দুই ভাই একসাথে তাদের আবদার জানালো।
ছেলেদের আবদার শুনে মা হেসে দেয়। ছেলেদের বলে, 'তোরা ভালো কইরা গা ঢইলা গোসল কইরা আয়। তোদের বাপ বাজারে গেছে। আসার সময় চাউল নিয়া আইবো। আমি মাছ কাইটা লই। তোদের বাপ আইলেই চুলায় রান্না বয়ামু। '
জামাল কামাল গোসলে যায়। কিসের আর গোসল! তাদের চোখে ভাসছে গরম ধোঁয়া উঠা প্লেট ভর্তি ভাত, চুনোপুটি ভাজা আর কই মাছের ঝোল।
জামাল কামালের মা মাছ কেটে ধুঁয়ে লবণ হলুদ মাখিয়ে চুলার সামনে বসে আছে। চাল আর তেল নিয়ে জামাল কামালের বাপ আসলেই যেন চুলায় আগুন দিতে পারে। বেলা গড়ায়, জামালের কামালের পেটের ক্ষুধা বাড়ে, কিন্তু তাদের বাপ চাল তেল নিয়ে আসে না।
জামাল কামালের মা চুলার পাশ থেকে উঠে একবার রাস্তার কাছে গেলো। তার মনেও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। তিনি দেখলেন রাস্তা দিয়ে ওই পাড়ার মুন্সী চাচা দৌড়ে তাদের বাড়ির দিকে আসছে। তিনি মুন্সী চাচার দৌঁড়ানোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
হাঁপাতে হাঁপাতে মুন্সী চাচা তার কাছে এসে বললো, 'জামাল কামাল কই গো, বৌমা? তাগোরে লইয়া আমার লগে আইয়ো। জামাল কামালের বাপ বেহুঁশ হইয়া বাজারে পইড়া রইছে। করোনার ডরে কেউ ধরতাছে না। '
মুন্সী চাচার কথা শুনে জামাল কামালের মা চিল্লাইয়া জামাল কামালরে ডাকলো। দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি মুন্সী চাচার পিছন পিছন ছুটলেন। এই দিকে চুলার পাড়ে রইলো লবণ হলুদ দিয়ে মাখানো জামাল কামালের অনেক সাধের চুনোপুঁটি, কই আর টাকি মাছ।
#সুখীপুরের_জামাল_কামাল
#গল্প
ছবি : ইয়াসিন প্রধান সাজিদ