গল্পঃ `অভাগা`
- কামরুন নাহার স্মৃতি
- জুলাই ২৩, ২০২০
ফজরের ওয়াক্তে প্রতিদিনকার মতো বাবা আর আমি নামাজের জন্য মসজিদে গেলাম। নামাজ শেষ করে বাবা শান্তভাবে আমার হাত টেনে নিয়ে বললেন,
- এই বৃদ্ধ বাবার একটা কথা রাখবি খোকা?"
আমি ধরে আসা গলায় বললাম,
- হুম, বলো।
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
- আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আয় খোকা। প্রতিদিনকার এই অশান্তি থেকে তুই মুক্তি পাবি। আমার আর ক'দিন আছে , এক পা কবরে গেছে। এইকয়েকটা দিন আমি শান্তিতে থাকতে চাই। আমার জন্য তোর সংসারটা ভাঙ্গতে আমি দেখতে পারবোনা। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাই খোকা, ব্যবস্থা কর।
বলতে বাবার গলা ধরে আসছিল, স্বর ছোট হয়ে আসছিল, বুকটা ফেটে যাচ্ছিল সে আমি ভালোই বুঝতে পারছি। কথাগুলো একমনে বলে বাবা মাথা নিচু করল। বাবার নিচু মাথা আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিতে চাচ্ছে। যে আমার মাথা উচু করতে সদা প্রস্তুত ছিল সেই বাবার নিচু মাথা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। আমি মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম,
বাবা সব শুনে ফেলে নি তো?
আমার আর তনয়ার সব কথা কি বাবা শুনে নিয়েছে?
.....
তনয়াটা আজকাল বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। বাবাকে নাকি সে একদমই সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু আমি তো জানি আসলে কে সহ্য করছে আর কি! সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ি এসে যে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেব সেই উপায়ও নেই। দিন শেষে ফিরে কখনো তনয়ার মুখে শুনিনি আজ তার কোন অভিযোগ নেই। তনয়ার সমস্ত অভিযোগ জুড়ে থাকে শুধু বাবা আর বাবা। বাবা এই করেছে, বাবা ওই করেছে, বাবা এটা শোনেনি তো বাবা এই বলেছে! আমি তনয়াকে অনেকবার বুঝিয়েছি,
- তুমি এই পৃথিবীতে খারাপ স্বামী পাবে, খারাপ বউ পাবে, খারাপ সন্তান পাবে, খারাপ মানুষ পাবে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা খুঁজে পাবেনা। বাবা কখনো বৃদ্ধ হয়না, বাবা বাবাই হয়! বাবার তুলনা অন্য কিছুতে তুমি খুঁজে পাবেনা।
তনয়া না আমার কথা বুঝেছে আর না আমাকে। কথার উল্টো মানে বের করে বলেছে, তার মানে তুমি বোঝাচ্ছো আমি খারাপ! স্পষ্ট করে বললেই পারো, আমি খারাপ। তোমার বাবা ভালো আর আমি খুব খারাপ বলো....!
আমি কিছু বলার মতো পেলাম না, চুপ করে গেলাম। কিন্তু আজ রাতে তনয়া সব সীমা পার করে ফেলেছে। ফোনে ওর মায়ের সাথে কথা বলার সময় নির্লজ্জের মতো বলল,
- বুড়োটা মরলে বাঁচি! এতো মানুষ মরে, বুড়োটা মরে না। কই মাছের প্রাণ, আমার হাড় মাংস না জ্বালাইয়াই মরবো। মরলে একটু বাঁচি।
কথাগুলো শুনে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না। তনয়াকে বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম, ভেবেছিলাম বাবা মা যাকে আনবে সেই হয়তো পারবে তাদের সুখি করতে কিন্তু এভাবে যে সবটা বদলে যাবে তা কখনোই ভাবিনি। বিয়ের কিছুদিনের মাথায় মা মারা গেলেন আর তারপর থেকেই বাবা সহ্য করছে সবটা। বাবা আর ছোট্ট ছেলেটার মুখের দিকে চেয়ে সবটা মেনে নিয়েছি কিন্তু আজ সবটা নিয়মের বাহিরে চলে গেছে। তনয়া বরাবরই স্বার্থপর ছিল। নিজের ছাড়া আর কিছু বুঝতে শিখেছে বলে মনে হয়না। ওর সবটা জুড়ে থাকে শুধু আমি, আমি আর আমি শব্দটা কিন্তু মধ্যবিত্ত মানুষদের সবসময় আমিকে নিয়ে ভাবলে চলে না, বেশিরভাগ সময়ই তুমি, তোমরা শব্দটার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়। এটা আমি ওকে কখনোই বোঝাতে পারিনি। চেয়ার টেনে নিয়ে তনয়ার সামনে বসে বললাম,
- বাবারা কখনো বুড়ো হয়না তনয়া, তুমি বাবার মৃত্যু চাইতে পারোনা কোনভাবেই!
তনয়া নিজের জেদ বজায় রেখে স্বর উচু করেই বলল,
- একশোবার বলবো, হাজার বার বলবো। বুড়ো মরে না!
কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার পাঁচটা আঙ্গুলের ছাপ তনয়ার গালে ফুটে উঠল। এর আগে কখনো আমি তনয়ার গায়ে হাত তুলিনি কিন্তু আজ বাধ্য হলাম এই কাজটা করতে।
নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত গলায় তনয়াকে বললাম,
তুমি শুধু চেনো ব্যবসায়ী সজিবকে কিন্তু তুমি চেনোনা এক কৃষকের দিনরাত পরিশ্রম করে বড় করা সেই সজিবকে। হ্যা আমি সেই সজিব। এতো বড় ব্যবসা, মান - সম্মান, টাকা পয়সা সবকিছুর পিছনে আছে ওই বৃদ্ধ মানুষটাই, যে আমার বাবা। আমাদের অভাবের সংসারে বাবা কখনো আমাকে অভাব কি বুঝতে দেয়নি, নিজে না খেয়ে আমার মুখে ভাত তুলে দিয়েছে। নিজে রাস্তা হেটে টাকা বাঁচিয়ে আমার হাতে টাকা তুলে দিয়েছে। নিজে সারাদিন জমিতে খেটেছে অথচ আমাকে কখনো কাঁদা মাটিতে কাজ করতে দেয়নি। একমাত্র সন্তানকে অনেক কষ্টে গ্রাম থেকে শহরে পড়াশুনা শিখেয়েছে কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে দেয়নি তাদের কষ্ট। আজ আমি যা তার সবটাই আমার বাবা। বাবা ছাড়া আমি কিচ্ছু না, কেউ না। এরপরও তুমি বলবে আমি বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো। যে বাবা সারাজীবন আমার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিল আজ আমি তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো!
তনয়া নির্লজ্জের মতো বলল,
- হ্যা রেখে আসবে। মাসে মাসে আমরা গিয়ে দেখে আসব, টাকা পাঠাবো কিন্তু সমাজে আমাদের একটা স্ট্যাটাস আছে! হয় এই বাড়িতে তোমার বাবা থাকবে নয় আমি!
তনয়ার কথা শুনে আমার মাথা কাজ করছিল না, সারারাত ঘুমাতে পারিনি।
.....
বাবা মাথায় হাত দিয়ে বলল,
- অতো ভাবিস না খোকা, তুই অনেক বড় হবি। সব ঠিক হয়ে যাবে।
কথাটা শুনে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল __ আমি আর বড় হতে চাইনা বাবা, আমি তোমার মতোই কৃষক হতে চাই। যে সমাজে বাবারা অচল পয়সা হয়ে যায় সেই সমাজে আমি কৃষক হতে চাই।
বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবা সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। নিজেকে ধিক্কার দিলাম নিজেই। তনয়া হাসতে হাসতে বলল,
আমি জানতাম তুমি আমার কথাটাই শুনবে।
আমি চুপ করে গেলাম। কিই বা বলব আর! যেখানে বাবা নিজে তার ছেলের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছে সেখানে কিছু বলা আর না বলা সমান। বাবার চলে যাওয়ার সবকিছু ঠিকঠাক, বাবাও প্রস্তুত। অসহায়ের মতো আমি চেয়ে আছি বাবার চেয়ারটার দিকে, ছবি আর মুখটার দিকে।
বাবার চলে যাওয়ার কথা শুনে আমার ছেলেটা পড়ার টেবিল ছেড়ে আমার কোলে বসে চুপটি করে বলল,
- বাবা দাদু কোথায় যাচ্ছে? আবার কবে আসবে?
সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতেও আমার বুকটা কেঁপে উঠল। আমি উত্তর দিতে পারলাম না। আমার কাছে উত্তর না পেয়ে মায়ের কাছে বায়না ধরল ছেলেটা। তনয়া সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিল,
- দাদুর তো বয়স হয়েছে তাই নতুন জায়গায় যাচ্ছে, সেখানে আরো অনেক দাদু আছে। দাদুর তো এখানে ভীষণ একা লাগে।
ছেলেটা অনেককিছু বুঝতে চেয়ে আবার প্রশ্ন করল,
- আচ্ছা মাম্মা, আমি থাকতেও দাদুর একা লাগে কেন?
তনয়া রেগে বলল,
- এতো তোমায় বুঝতে হবে না, দাদুর বয়স হয়েছে তাই এ বাড়িতে আর থাকতে পারবেন না।
আমার ছোট্ট ছেলেটা কি বুঝল কে জানে! বাবাকে টেনে নিয়ে এসে বলল,
- দাদু, মা বলছে তোমার এখানে একা লাগে তাই তুমি চলে যাচ্ছ?
বাবা মিথ্যে হাসি হেসে বলল,
- হ্যা দাদু, মা ঠিক বলেছে। আমার তো বয়স হয়েছে তাই খুব একা লাগে।
আমার ছোট্ট ছেলেটা কি বুঝল কে জানে! আর একটাও কথা বাড়ালো না সে, হয়তো বুঝতে পেরেছিল কোন কথাই আর তার দাদুকে আটকাতে পারবে না।
বাবা চলে গেল নিঃশব্দে, আমি হাজার চেয়েও কিচ্ছু করতে পারিনি। বাবাকে দেয়া কথা আমার আর বাবার মাঝের সবটা জুড়ে জায়গা করে নিল। আমি দিনরাত শুধু এটাই ভাবি, আমি কেন বাবার মতো কৃষক হলাম না! তাহলে হয়তো বৌমার স্ট্যাটাস, ছেলের বিশাল সম্পত্তির বাহিরে কৃষক ছেলে, ছেলে বৌমার ঘরে বাবার ঠাঁই হতো!!
বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার প্রায় তিনমাস হয়ে গেছে। এরমধ্যে আমি একবারও বাবার মুখোমুখি হইনি, সেই সাহসটা নেই আমার। বাবাকে দেখে আসা, টাকা পাঠানো সবটা তনয়াই করে। আমি শুধু মাঝেমাঝে দূর থেকে বাবাকে একনজর দেখে আসি। তনয়া এখন আর আমার সাথে থাকেনা, বাবা চলে যাওয়ার পরপরই তনয়াকে তার বাবার বাড়ি রেখে এসেছি। টাকা পয়সা সময় মতো পাঠিয়ে দেই, বাবাকে ওখান থেকেই দিয়ে আসে ও।
তিনমাসও প্রায় শেষ হতে চললো বাবার নতুন ঠিকানার। আমি আমার কৃষক বাবার চেয়ারের পাশে বসে প্রায়ই কথা বলি। আমার একা লাগার কথা বলি, কৃষক থেকে মালিক হওয়ার গল্প বলি। বাবা আদৌ শুনতে পায় কি না কে জানে! আজকাল অফিসে মন বসেনা, প্রায় বিকেলেই বাবার ঘরে মুখ গুজে সুখ খুঁজি। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। হঠাৎই তনয়ার চিৎকার শুনলাম,
- এদিকে একটু আসবে? দেখো কে এসেছে।
আমি অনেকটা বিরক্তি আর রাগ নিয়ে বাহিরে এলাম। তনয়া কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমার হাতদুটো ধরে বললো,
- একবার ক্ষমা করা যায় না? আর একবার? আর কখনো এমন হবে না।
তনয়ার চোখ মুখ হঠাৎই রঙ হারালো। কিছু একটা বলতে যাবে কিন্তু বারবার আটকে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে শুধু বলল,
- বাবা আপনি ঘরে যান, আপনাকে আর কোথাও যেতে হবেনা।
জানো, আমার ভাই আর ভাবি যখন বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার কথা বলছিল তখন আমার তোমার কথা মনে হয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি সন্তান থাকতেও এক বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে চাইলে সন্তান কতোটা অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে। আমি বাবার সমস্ত খরচের ভার নিয়েছি তোমার ভরসায় আর তোমার বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দেব আমার এতোটুকু সুখের আশায়! হ্যা, আমি স্বার্থপর, সারাজীবন নিজেকে নিয়েই ভেবেছি।কিন্তু বাবাকে ওখানে রেখে আসতে পারিনি সজিব, আমি বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি। সত্যিই আমরা কৃষকের সন্তান, এটা বলা লজ্জার নয়, গৌরবের।
বলেই বেরিয়ে গেল তনয়া। আমি স্পষ্ট দেখলাম তনয়ার চোখে পানি জমেছে! স্বার্থপরতা আর অহংকার চোখের পানি হয়ে অনবরত ঝড়ে পড়ছে।।