যেমন শাশুড়ি তেমন বউ (পর্ব-১)

  • কামরুন নাহার স্মৃতি
  • আগস্ট ১৬, ২০২০

আজ আমার বিয়ে। এটাকে অবশ্য লোকে বিয়ে বলবে কি না তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। রাহাত অনেকটা ভয়ে, চাপে পড়ে বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছে। রাহাত আর আমার প্রেম তিন বছর পেরিয়ে গেছে অথচ এখনও ছেলেটার সেই ভীতু ভীতু চাহনি আমাকে অবাকক করে দেয়! আমি অনেক কষ্টে আমার পরিবারকে সামলে নিয়েছি, সবাই মেনেও নিয়েছে আমাদের সম্পর্কটা কিন্তু রাহাত এখনও ওর পরিবারে নাকি বলেই উঠতে পারেনি। অনেকবার বলেছে এবারই বলছে অথচ এবার, এবার করে কতশত বার যে চলে গেছে তার হিসাব নেই। রাহাত ওর মা'কে ভীষণ ভয় পায়, মায়ের সামনে গেলে ওর পা কাঁপে, গা ঘামতে শুরু করে, গোছানো সব কথা এলোমেলো হয়ে যায় __এসব কথা বুক ফুলিয়ে বেশ কয়েকবার আমাকে বলেছে। ওর পরিবারের সবাই নাকি ওর মা'কে খুব ভয় পায়। আমি ভেবেই পাইনা কেন, মা আবার ভয়ের সম্পর্ক হলো নাকি! বাবা হলে তাও মেনে নেয়া যেত। রাহাত আর আমি পাশাপাশি বসে আছি, দুজনেই চুপচাপ। আমিই শুরু করলাম,

- রাহাত চলো আমরা ব্রেকাপ করে নেই, এ সম্পর্কটা রাখার কোন মানেই নেই।

- কি বলছ এসব তুমি? আমি তোমাকে ভালোবাসি!

- তাহলে চলো বিয়ে করে নেই, বউ শাশুড়ির যুদ্ধটা জমে যাবে। আমি যেদিন থেকে শুনেছি তোমার মা'কে তোমরা ভীষণ ভয় পাও, সেদিন থেকেই ভাবছি কবে তোমাকে বিয়ে করবো।

- মা জানতে পারলে বাড়ি ছাড়া করবে।

- ঠিকআছে রাহাত বাবু, তুমি মা'কে নিয়ে থাকো আমি বাবাকে ফোন দেই।

- বাবাকে কেন?

- বা রে! তুমি তো আর আমাকে বিয়ে করছো না, তাই বাবাকে বলি তার বন্ধুর ছেলের সাথেই বিয়েটা পাকাপাকি করুক। তোমার অপেক্ষায় তো আর বুড়ি হবো না!

- এসব কি বলো তুমি! তুমি তো আমাকে ভালোবাসো?

- বাসতাম। তুমি লক্ষ্ণি ছেলের মতো মায়ের কোলে ফিরে যাও আর হ্যা একসপ্তাহের মধ্যে আমার বিয়ে, গিফট পাঠায় দিও কিন্তু।

- না, তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করবে না।

- তাহলে চলো বিয়ে করি..........

অনেকটা বাধ্য হয়েই আমাকে বিয়ে করলো রাহাত। রাহাত জানে আমি ভীষণ জেদি আর বাবার বন্ধুর ছেলের কথা যে মিথ্যে নয় তাও সে ভালো করেই জানে। এটা করা ছাড়া ভীতু বাবুটার কাছে আর কোন উপায় ছিল না। বিয়েটা শেষ করে রাহাত শুকনো মুখে বলল,

- চলো তোমায় বাসায় নামিয়ে দেই।

- কি বলছ তুমি! আমি বাবার বাসায় যাবো কেন? বিয়ের পর কেউ বাপের কাছে থাকে বুঝি! এটা তো নিয়ম, তাও জাননা বুঝি!

- মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? আমার সাথে যাবে!

- হ্যা, খারাপ হয়ে গেছে! হয় নিয়ে যাবে, নয় তিন তালাক দেবে। তাড়াতাড়ি ঠিক করো!

- উফফফফ, এই হয়েছে এক জ্বালা। এমন জেদি মেয়ের সাথে পেরে উঠা যা তা কথা না। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো করে সবসময়, একটু বোঝার চেষ্টা করেনা। কি যে বিপদে পরেছি আল্লাহ পাক ভালো জানে......

__খুব ধীরে ধীরে বললো রাহাত। কথাগুলো শুনে আমার একটুও রাগ হলো না বরং ভালোই লাগলো এই ভেবে যে রাহাত আমার জেদের কাছে হেরে গেছে।

..

রাগে রাহাত কিছু না বলেই বাইকে গিয়ে উঠল, আমিও লক্ষ্ণি বউয়ের মতো ওকে অনুসরণ করলাম। হাজারো স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা দিলাম। এভাবে বিয়েটা না করলে কবে মায়ের ভয়ে অন্য কোথাও বিয়ে করে নেবে কে জানে! রাহাত বলে _ওর মাকে নাকি বাড়ির সবাই ভয় পায়! কিন্তু কেন? উনি তো মা __ বাঘ-ভাল্লুক তো আর নয়! আমি ঠিক শাশুড়িকে আমার মা বানিয়ে ফেলব। তখন আমার দুই মায়ের মধ্যে ভালোবাসার প্রতিযোগিতা হবে, কে আমাকে বেশি ভালোবাসে। আমি জানি আমার শাশুড়িই জিতবে, কেননা রাগী মানুষগুলো ভীষণ রকম ভালোবাসতে জানে। ননদ, জা, নতুন বাবা, নতুন মা, ভাসুর সবাইকে নিয়ে ভীষণ আনন্দে থাকবো। রাহাতের মুখে ওদের সবার কথা শুনেই মনে জায়গা করে দিয়েছি সবাইকে। আকাশ পাতাল ভাবছি হঠাৎ রাহাতের ডাকে চমকে উঠলাম। রাহাত ভীতু ভীতু কন্ঠে বলল,

- তুমি গাড়িতেই অপেক্ষা করো,, আমি ভেতরে গিয়ে দেখি কি অবস্থা। আমি না আসা পর্যন্ত একদম ঘরে ঢুকবে না কিন্তু।

বলেই চলে গেল রাহাত.....

আমি অপেক্ষা করছি তো করছিই, দেখিতে দেখতে ১৫মিনিট পার হয়ে গেল অথচ এই ভীতুরামটার দেখা নেই। এই ১৫মিনিট আমার কাছে ১৫বছরের মতই দীর্ঘ মনে হচ্ছে। আমি আস্তে আস্তে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম রাহাত একপাশে বসে আছে, কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু মুখ থেকে কথা বের হচ্ছেই না। হয়তো ও আমার কথাটাই বলার চেষ্টা করছে, বেচারা! ওকে দেখে এই মুহূর্তে আমার খুব মায়া হচ্ছে। হঠাৎ মায়ের চোখ আমার দিকে পড়ল.... কর্কশ স্বরে বললেন - কে তুমি? কি চাই এখানে?

আমি মাকে দেখতে লাগলাম, কি মায়াবী চেহারা অথচ ইয়া বড়ো বড়ো রাগের ঢিপি দিয়ে সব ভালোবাসা ঢেকে রেখেছে।

- কি হল কানে শুনতে পাও না!

- মা, আমি রাহাতের বিয়ে করা বউ।

- কি? রাহাতের বউ? মা? সব ঠিক করেই এসেছ দেখছি!

- হ্যা মা, আমি রাহাতের বউ।

- মানি না আমি...

- তাতে কি মা, বিয়েটা তো আর মিথ্যে হয়ে যাবে না তাতে।

- রাহাত এসব কি বলছে মেয়েটা? এক্ষুন্নি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাহিরে বের করে দিবি।

রাহাত হ্যা না কিছুই বলার অবস্থায় নেই। ও কি করবে হয়তো নিজেই বুঝতে পারছে না। আমার শ্বশুরটা ভীষণ ভালো মানুষ, বারবার তার রাগী বউটাকে সামলানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। আমি আমার আর রাহাতের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি শ্বশুর আর শাশুড়ির মাঝে। জা, ননদ, ভাসুর, রাহাত, শ্বশুর বাবা সবাই আছে কিন্তু রাগী শাশুড়ি মাকে সামলানোর কেউ নেই। সবাই ভীষণ ভয় পায় তাকে। আমি শাশুড়ি মায়ের কথা কানে না তুলে ভেতরে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়লাম। মা রাগে গজরাতে গজরাতে বুললেন, যাও বলছি আমার ঘর থেকে নইলে....

- নইলে কি মা? আমিও পুলিশ কমিশনারের মেয়ে, দেখি কেমন আমাকে বের করতে পারেন আর আইনত আমি রাহাতের স্ত্রী, এখনও তালাক হয়নি!

রাহাত কথাগুলো হা করে শুনছে আর মা রাগ সামলাতে না পেরে দ্রুত ঘরে চলে গেলেন। বাবা মানে শ্বশুরবাবা ফ্রিজ থেকে মিষ্টি এনে খাইয়ে আমাকে বরন করে নিলেন আর বললেন, তুমিই পারবে এমন রাগী শাশুড়িকে সামলাতে। রাহাত এখনও হয়তো সব বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি ঘরে ঢুকে ফ্রেস হয়ে বিকেলের নাস্তা বানালাম। রাতে খাবার টেবিলে অনেক গল্প হলো কিন্তু মা খেতে এলোনা। আমি খাবার নিয়ে রাগী শাশুড়ির ঘরে গেলাম। উনি তো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন _ আজকের রাতটাই তোমার এ বাড়িতে শেষরাত, সকাল হলে তুমি নিজে বেরিয়ে যাবে এ বাড়ি থেকে নইলে আমার কেরামতি দেখবে! তোমার মতো কতশত মানুষকে সোজা করেছি তার হিসাব নেই। এখন ও সময় আছে নিজেকে শুধরে নাও নইলে বিপদ আছে।

- আমিও ঠিক এ কথাটাই বলি মা, এখনই সময় থাকতে নিজেকে সামলে নিন, নইলে বড্ড বিপদ আছে সামনে আর আপনার দলের সবাই কিন্তু এখন আমার দলে, এই কথাটা মাথায় রাখবেন আর আমি রাহাতের স্ত্রী, কেউ আমাকে রাহাতের থেকে আলাদা করতে পারবে না, কেউ না.......

কথাগুলো শুনে রাগী শাশুড়িমা কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেলেন আর কথাগুলো বলতে বলতে আমার চোখ বেয়ে কখন যে পানি নেমে এসেছে নিজেই জানিনা! আমি তো মা করে রাখতে চেয়েছিলাম আর মেয়ে হয়েই থাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু এমন শাশুড়ির সাথে থাকতে হলে এভাবেই থাকতে হবে।

(চলবে.....)

Leave a Comment