যেমন শাশুড়ি তেমন বউ (পর্ব-৬)
- কামরুন নাহার স্মৃতি
- অক্টোবর ১৯, ২০২০
রুমি হয়তো শুনেছে কথাগুলো, শুনেছে হয়তো আমার চলে যাওয়ার কথাটা। রুমি আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো, প্রশ্নগুলো ওর চোখে ছলছলিয়ে উঠল। খুব জোড়ে অনেকটা তীরের মতো আমার বুকেও বিঁধল।
- ভাবি, তুমিই তো বললে আমাকে ছেড়ে যাবে না তাহলে কেন চলে যাবে? আমরা তোমার আপন হয়ে উঠতে পারিনি এখনও, সেজন্যই চলে যাচ্ছ? না কি আমি কখনওই তোমার বোন হতে পারিনি বলে ফেলে রেখে যাচ্ছ? ও, অবশ্য আমি তো আর তোমার আপন বোন না ; হলে হয়তো এভাবে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতে না!
কি বলব এই মেয়েটাকে, কি বা উত্তর দেব প্রশ্নের! সত্যিই জানিনা আমি, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সত্যিই আছে তো আমার কাছে? চুপচাপ ওর অভিমান আর আমার অক্ষমতা মিশে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমার কাছে!
আরো পড়ুনঃ মর্নিং সিকনেস কাদের বেশী হয় ?
রাতে রাহাতকে হাসি মুখে বললাম, তুমি বরং মা যা বললো তাই করো, আর কতো কষ্ট পাবে মা আমার জন্য বলো! আর আমারও ভালো লাগছে না আর অপমান, ঘৃনা নিয়ে সংসার সাজাতে।আমি জানি বিয়ে মানে মানিয়ে নিয়ে চলা কিন্তু তাই বলে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়া নিশ্চয় নয়। যে যখন যেভাবে পারছে, আমাদের এই বিয়েটা নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে, আমারও যে খারাপ লাগতে পারে আর আমিও যে মানুষ সেই কথাটা কেউ মাথায় রেখেছে! আমি সত্যিই স্বামী - শ্বশুরবাড়ি পেতাম কি না জানিনা, হয়তো পেতাম না তাই তোমাদের ঘাড়ে ঝুলে পড়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করো রাহাত, আমার বাবা - মা কিন্তু দায় থেকে মুক্তি পাবার কথা একটুও ভাবে নি। কথাগুলো শুনে রাহাত হয়তো কোন উত্তর খুঁজে পেল না, তাই মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। কথাগুলো বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো, রাহাত হয়তো বুঝতেও পারছে। পারলে ভালো করে ছেলেটার খোঁজখবর নাও, হুটহাট কিছু করে বসো না। আমি না হয় চলেই যাবো সকাল হলে। রাহাত কেমন যেন চুপচাপ, একটা কথাও বলল না ও। অবশ্য কি বা বলবে, আমি তো জানি ভীতুরামটা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে, হয়তো আমার চেয়েও বেশি, হয়তো তার চেয়েও বেশি। কিন্তু ভালোবাসার জন্য মা'কে কষ্ট দেয়াটা একদম ঠিক নয়। রাহাত না হয় তাই করুক যা উচিত।
রাতেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখলাম চলে যাবার, সাথে তো আর খুব বেশি কিছু আনি নি। মাত্র কয়েকটা জিনিস। রাহাতের সাথে একটা কথাও হয়নি আর। যে যার মতো খেয়ে নিয়েছে, শাশুড়ি'মাও খেয়েছে। রাহাত এসে শুয়ে পড়েছে হয়তো ওর চোখের ঘুমগুলো বহুদূরে হারিয়ে গেছে। আমিও তো জেগে আছি ও কি তা জানে! এইসময় ভীষণ একাকী লাগছে আমাকে, হেরে গেছি আমি। চাপা কান্না কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাকে, বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যেতে চাচ্ছে। আমার ভাগ্য এতোটা খারাপ! ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানিনা।
আরো পড়ুনঃ আপনার ওজন বাড়াবে প্রতিদিনের যে খাদ্য তালিকা !
---
সকালবেলা রাহাতের ডাকে ঘুম ভাঙলো,
- এই ওঠো, চলো।
চোখ মলতে মলতে বললাম,
- যাবো তো রাহাত, সব গোছানোই আছে। এতো তাড়া কেন তোমার?
- তোমার কি মনে হয়, আমি চাই তুমি চলে যাও! আরে রুমি বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত মা তোমাকে থাকতে বলেছে।
- কেন?
- রুমি নাকি মা'কে বলেছে, তুমি না থাকলে বিয়েই করবে না।
- ওও..
- আর বিয়ের তারিখও ঠিক। পরশু বিয়ে।
মা আর বাবা খোঁজ খবর নিয়ে এসেছে, সবকিছু ঠিকঠাক আর বিয়ের তারিখটাও ঠিক।
- কবে?
- পরশু।
- আচ্ছা রাহাত, তোমার কি মনে হয় না, সবকিছু একটু তাড়াতাড়িই করা হচ্ছে। আমার কাছে একদম ভালো লাগছে না, ধীরেসুস্থে - বুঝে শুনে এগোলে কি এমন সমস্যা আমি তো বুঝতেই পাচ্ছি না।
- হ্যা কিন্তু মা।
- মা না হয় এখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব কম জানে কিন্তু তুমি তো জানো, এখন মানুষকে বিশ্বাস করা কতো কঠিন আর সেখানে তোমার বোনের জীবনের প্রশ্ন! তোমার কি আর একটু বেশি ভাবা উচিত নয়, বলো।
- হ্যা তুমি ঠিকই বলেছো কিন্তু আমি কি করবো, মা - বাবা তো তারিখ ঠিক করে এসেছে।
- আচ্ছা রাহাত এমন ও তো হতে পারে ওদের ফ্যামিলি আমাদের থেকে কিছু লুকানোর জন্য এতো তাড়াতাড়ি করছে, যাতে আমরা কিছু টের পাওয়ার আগেই সব হয়ে যায়!
আরো পড়ুনঃ ঘরের কাজের মাধ্যমেই গড়ে তুলন আকর্ষণীয় ফিগার
- আচ্ছা, তুমি যাও ফ্রেস হয়ে খেয়ে নাও। কয়টা বাজে খেয়াল আছে?
- কয়টা বাজে?
- ৯বেজে ৫৫মিনিট, অবশ্য এখনো ১০টা বাজেনি।
- কি বলো ১০টা বাজে অথচ মায়ের চিৎকার নাই। আমি কি স্বপ্ন দেখছি?
- না, ম্যাম। আপনি জেগে আছেন । মা ছিলনা, বেরিয়েছিল।
- তাই বলো!
এতো তাড়াহুড়ো করে রুমির বিয়েটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না। আমার কেমন যেন লাগছে, মনটা ঠিক সায় দিচ্ছে না। শাশুড়ি'মাকেও বলতে পারবো না, বললেই আবার ভাববে আমি রুমির খারাপ চাই। খাওয়া - দাওয়া সেরে জায়ের সাথে রুমির বিষয়টা নিয়ে কথা বলবো ভেবে বসার রুমে দু'জনে বসে পড়লাম।
- আচ্ছা ভাবি, রুমির বিয়েটা নিয়ে এতো তাড়াহুড়া করা হচ্ছে ;তোমার মন সায় দিচ্ছে?
- না রে কিন্তু মা যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর মা তো এটাই চাইছিল।
- কি চাইছিল ভাবি?
- মা বলে অনার্স শেষ করলে নাকি রুমির যোগ্য পাত্র পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে আর তখন ও তো চাইবে না ওর চেয়ে কম শিক্ষিত ছেলেকে বিয়ে করতে তাই। এবার তো রুমি ফাইনাল ইয়ারে, সেজন্য মা চাইছিল কয়েকমাসের মধ্যেই যেন বিয়েটা হয়।
- এটা কেমন চিন্তা ভাবি?
- কি বলব বল! আর ছেলেটা ও নাকি ভালো চাকরি করে, অনার্স কমপ্লিট।
- ছেলেটার রিলেশন আছে কি না বা বাড়ির চাপে পড়ে বিয়ে করছে কি না তাও তো আমাদের জানাটা প্রয়োজন, তাইনা?
- তুই ঠিকই বলেছিস, কিন্তু মা কি শুনবে?
- আমি কথা বলবো।
- দেখ বোন কোন ঝামেলা করিস না।
- হু, করবো না।
দুপুরের রান্না করতে ভাবি রান্নাঘরে ঢুকল, আমারও সাহায্য করা দরকার কিন্তু শাশুড়ি'মায়ের সাথে কথা বলাটাও দরকার। ভাবিকে বলে শাশুড়ি'মায়ের কাছে গেলাম। আজ আমার কপালে কি আছে, কে জানে! যাই থাক কথাটা বলতেই হবে, আমার সন্দেহ হচ্ছে বিষয়টা নিয়ে। আমি শাশুড়ি'মায়ের অনুমিত ছাড়াই ঘরে ঢুকলাম।
- মা একটা কথা বলার ছিলো।
- তুমি আবার আমার ঘরে, বাহিরে শান্তি পাওনা না আবার ঘরেও জ্বালাতে এসে গেছ?
কথায় আছে না,
"দেখতে না পারলে চলন বাঁকা "
আমার হয়েছে সেই দশা।
- না মা, আমার মনে হয় ছেলেটা সম্পর্কে আর একটু খোঁজ নিন আর যেহেতু বাহিরে চাকরি করে তাই সেখানে একবার খোঁজ নেয়াটা দরকার ছিল না মা? এমনও তো হতে পারে ওরা কিছু আড়াল করার চেষ্টা।
- চুপ, একদম চুপ। কি মনে হয় তোমার, আমি মানুষ চিনি না! তুমিই সব মানুষ চিনে বসে আছো, তাইনা? তুমি সবজান্তা, সব জানো তুমি আর আমরা কিচ্ছু জানিনা!
- না মা, তা নয়। একটু দেখেশুনে নিলে ভালো হয় তাই।
- মনে করো আমি আমার মেয়েকে জলে ফেলে দিচ্ছি, তোমার তাতে কি? তুমি তো দু'দিনের জন্য এসেছ, নিজেকে কি এই বাড়ির কর্তী মনে করছ না কি!
- মা আসলে...
- আমার ঘর থেকে চলে যাও আর এই ব্যাপারটায় আমার স্বামী বা ছেলের মাথাটা খেও না। যাও এখান থেকে।
আরো পড়ুনঃ ‘ওয়াটার থেরাপি’ -তে আপনার ওজন কমিয়ে নিন খুব সহজে
আর কোন কথা বলতে পারিনি, কি বলতাম আমি! উনি রুমির মা আর আমি অস্থায়ী ভাবি, আজ আছি তো কাল নেই। কিসের অধিকারে প্রশ্ন করতাম আমি আর কিসেরই বা সম্পর্কে? ভালোবাসার সম্পর্ক বা হৃদয়ের বন্ধন এসব দেখানো বা যুদ্ধ করে বোঝানো যায় না। আমার মনের সন্দেহ হয়তো অমূলক। আমার সাথে খারাপ ঘটা দেখতে দেখতে হয়তো খারাপটা মাথায় ঢুকে গেছে। আমার বোন নেই, এখানে এসে বোন পেয়েছি ঠিকই কিন্তু অধিকার পাইনি। তাহলে কি সম্পর্ক ছাড়া সম্পর্কগুলোতে অধিকার থাকেনা! যা কিছু হোক ভালো হোক, আমার বোনটা ভালো থাক। বাড়িতে আত্নীয় আসা শুরু হয়ে গেছে আর আমাদের ঝুলন্ত সম্পর্কের প্রশ্নটাও। আমি সত্যিই আর পারছি না এতোটা প্রশ্নে প্রশ্নে নিজেকে বিদ্ধ করতে।
....
কেমন যেন চুপচাপ কেটে গেল একটা দিন। আজ রাতটা পেরুলেই রুমি আমাদের হয়েও আমাদের না। বিদায় এতো কষ্টের কেন হয়, সত্যিই আমি জানি না। একটা মেয়ে বাবা - মা, পছন্দ - অপছন্দ, ভালো লাগা সব ভুলে নতুন করে সবকিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকে অথচ সে কখনো আর মা পায়না, পায় শাশুড়ি। মেয়ে হতে পারে না, হয় বউ। চোখটা একদম বাঁধা মানে না, সময়ে - অসময়ে বৃষ্টি ঝড়ায়। বিদায়ের সুর কেন এতো কষ্টের! আমি তো কয়েকদিন এ বাড়িতে এসেছি তাই আমার এতো কষ্ট হচ্ছে ওকে বিদায় দিতে হবে ভেবে তাহলে শাশুড়ি'মায়ের না জানি কত কষ্ট হচ্ছে! রাগী মানুষগুলো রাগ দিয়ে যেমন ঢেকে রাখে তেমনি আড়াল করার চেষ্টা করে কষ্ট - বেদনাও। রাহাতের চোখমুখও কেমন যেন বেদনার গাঢ় রং এ ঢাকা। ও তো খুব ভালোবাসে বোনটাকে।
হাজারো প্রশ্ন আর বেদনার কালচে রঙে রাতটা পেরিয়ে গেল।
আজই সেই দিন, যেদিন আরেকটা মেয়ে নতুন সংসার সাজাতে নিজের অস্তিত্ব, কাছের মানুষগুলোকে ছেড়ে অন্যকে কাছে আনার আপ্রান চেষ্টা করে যাবে। রুমির চোখমুখও শুকিয়ে গেছে, সারারাত ঘুমোয় নি হয়তো। বাবা - মা, রাহাত, জা, ভাসুর, দেবর সবার মুখে গম্ভীরতার ছাপ স্পষ্ট। আজকের দিনটায় সবাই ব্যস্ত, একটুও সময় নেই খারাপ লাগা কিংবা কষ্ট নিয়ে হিসেব করার। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো কিন্তু খাবার টেবিলে বসার না আছে কারো ইচ্ছা আর না আছে সময়। আত্নীয় - স্বজন ঠিকঠাক খেলেই হলো। বিকেলের দিকে বরযাত্রী এলো। চারপাশে কতো আলো আর আলো, এতো আলোর মাঝেও আমাদের পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকার আর শুন্যতা।
দেখতে দেখতে বিয়েটাও শেষ, এবার এলো সেই কঠিন মুহূর্ত, তারপর বিদায় ! সত্যিই কি কাছের মানুষকে বিদায় দেয়া যায়? রুমি আমাকে জড়িয়ে ভীষণ কাঁদছিল কিন্তু কি সান্তনা দেব আমি! আমি যেন বাকশক্তিটাই হারিয়ে ফেলেছি। মা অবশ্য কাঁদলো না বলল ভালো ভাবে থেক, নিজের খেয়াল রেখো। বাবা - রাহাত একটাও কথা বলতে পারেনি। রুমি চলে গেল নতুন সংসারে, নতুন স্বপ্নকে সাজাতে। মায়ের ধৈর্য আছে বলতে হয় নইলে কি আর এভাবে কেউ নিজেকে শক্ত করে রাখতে পারে। সকাল থেকে কারো গলা দিয়ে কিচ্ছু নামেনি। ভাবি খাবার নিয়ে গেল বাবা আর ভাইয়ের জন্য, আমি মা'য়ের ঘরে খাবার নিয়ে গেলাম। বাহির থেকে দেখলাম - মা ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো। নিজেকে শক্ত রেখে মেয়ের বিয়েটা দিয়েছে কিন্তু যতোই হোক মা তো ! আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না, সান্তনা দিতে আমি অপারগ। মায়ের পাশে গিয়ে বললাম,
- মা, চিন্তা করেন না। রুমি নিশ্চয় ভালো থাকবে মা।
শাশুড়ি'মা কিছুই বলল না, আজ আমাকে বকলো না। আমার কথার বিরোধিতাও করলো না। শুধু বললো - তাই যেন হয়। এই প্রথম আমার কথায় একমত হলেন শাশুড়ি'মা।
আরো পড়ুনঃ আপনার ওজন কমছে, কিন্ত পেট বা কোমরের পরিধির পরিমাপ ঠিক আছে তো ?
চলবে...