অত্যাচারীর খোলস
- ফারজানা আক্তার
- মে ২৬, ২০২১
তুমি কি জানো না আমাদের বাড়ির কোন মেয়ে চাকরি করে না ? নাকি বিদেশে পড়াশোনা করে বাড়ির নিয়মকানুন সব ভুলে গেছো ? '
টেবিলে বসে বাবা আমাকে উদ্দেশ্যে করে কথাগুলো বলছেন। চারপাশে পিন পতন নিরবতা। কেউ ভয়ে প্লেটে হাত দিচ্ছে না। মা, বড় ভাবী, মেজো ভাবী পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের ঘরের মেয়েরা ছেলেদের পরে খায়। আমরা যখন খেতে বসি তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে খাবার পরিবেশন করেন। আমাদের বাড়িতে পাঁচ জন কাজের লোক আছেন। কিন্তু তবুও রান্না করতে হবে মা এবং ভাবীদের। খাবার পরিবেশন তাদের হাত দিয়েই করতে হবে। বাড়ির মধ্যে বেশ অদ্ভুত কিছু নিয়ম আছে।
আমরা তিনভাই এবং দুই বোন। দুই বোনের বিয়ে হয় গেছে এবং সুন্দর সংসার করছে। দুই ভাই বিয়ে করেছেন কিন্তু সুন্দর সংসার করছেন কিনা বুঝতে পারছি না। আমি এখনো বিয়ে করিনি। আমি তারেক। ৭ মাস আগে দেশে ফিরেছি। তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। খেলতে গিয়ে ডান পায়ে প্রচন্ড ব্যথা পাই। সেই ব্যথা দিনকে দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিলো। তখন উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে বাহিরে পাঠানো হয়। মা সাথে গিয়েছিলেন। ৬ মাস পর আমি সুস্থ হলে মা ফিরে আসেন।
আরো পড়ুন : বাড়িতে গ্যাসে রান্না হয়? তাহলে এই তথ্যটি আজই জানুন!
সেখানকার ডাক্তার বলেছিলেন আমাকে নিয়মিত মেডিকেল চেকআপে থাকতে হবে। মা আমাকে নিয়েই ফিরতে চেয়েছিলেন। সময়ে সময়ে গিয়ে চেকআপ করিয়ে নিয়ে আসবেন। কিন্তু বাবা রাজি হননি। আমি আমেরিকাতেই রয়ে গেলাম। সেখানে আমার বড় খালা, ছোট ফুফু এবং বাবা / মায়ের দিকের অনেক আত্মীয় থাকেন। প্রথম কয়েক বছর আমি সবার বাসায় ঘুরেফিরে থাকতাম। তারপর নিজের আলাদা ফ্ল্যাট নেই।
বয়স কম ছিলো একা থাকতে মা দেননি। তাই সবার বাসায় ঘুরে ফিরে থাকতাম। আমার বাবা যথেষ্ট পরিমানে সামর্থ্যবান লোক। আমরা তিন ভাই কোন পেশার সাথে যুক্ত না থেকে অনায়াসে খেয়ে পরে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।
দাদা বিত্তবান লোক ছিলেন। বাবা দাদার একমাত্র সন্তান। দাদার সকলকিছু বাবা পেয়েছেন। বাবা নিজে পরিশ্রম করে সেই সকল সম্পত্তি আরো কয়েকগুন বানিয়েছেন। আমার বাবা অর্থের দিক থেকে ধনী হয়েছেন, কিন্তু মনের দিক থেকে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছেন। নিজের বাবা সম্পর্কে কথাগুলো বলতে খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি বরাবর নিজস্ব চিন্তা - ভাবনায় চলাফেরা এবং জীবনযাপন করতে পছন্দ করি। ছোটবেলা থেকে বাবার সকলকিছুতে আমার আপত্তি ছিল। ঠিক এই কারণে আমার চিকিৎসার পরেও বাবা আমাকে দেশে আসতে দেননি।
অথচ আমি মায়ের কাছে থাকতে চেয়েছিলাম আর মা চেয়েছিলো অন্য সব সন্তানদের মতো আমাকেও কাছে আগলে রাখতে। কত রাত আমি ফোন করে মায়ের কাছে কান্নাকাটি করেছি, কতরাত আমার মা কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন, কিন্তু আমার বাবার মন গলেনি। তার সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত।
আরো পড়ুন : জেনে নিন রুম হিটার ছাড়া ঘর গরম রাখার কয়েকটি দারুন টিপস!
বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন আর্কিটেক্ট হই। কিন্তু আমি হলাম লইয়ার। এই নিয়ে তিনি আমার সাথে গত ৫ বছর ধরে কোন কথা বলেন না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি কথা বলার কিন্তু বলেননি। পরে আমিও হাল ছেড়ে দিয়েছি। বিদেশে থাকাকালীন প্রথম কয়েক বছর আমি তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। তারপর নিজের যাবতীয় সব খরচ নিজে বহন করতে শিখে গেছি। একমাত্র বাবা ছাড়া বাকি সবার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। বাবার খোঁজ খবর মা, ভাই - ভাবী, বোনদের কাছ থেকে নিতাম। বাবা ভালো আছেন শুনলে ভালো লাগতো। প্রায় মনে হতো বাবা অভিমান ভেঙে আমার সাথে কথা বলবেন। কিন্তু সেট শুধু মনে হতো, সত্যি হয়নি কখনো।
দেশে আসার পরেও তিনি আমার সাথে কথা বলেননি। তার সাথে দেখা করতে তার রুমে গেলাম আর তিনি বের হয়ে গেলেন। একজন বাবা শুধুমাত্র তার পছন্দের পেশায় যাইনি বলে এতো অভিমান করতে পারে ? মাঝে মাঝে প্রশ্নটা নিজেকেই করি এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলি। টাকা পয়সা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। আমার বাবা শুধু অন্ধ হননি, সাথে নিজের বিবেক - বুদ্ধিও বন্ধক দিয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘ ৫ বছর পর আজকে খাবার টেবিলে তিনি আমাকে দুইটা প্রশ্ন করেছেন তাও ঝাঁঝালো সুরে। প্রশ্নটা বিথীকে নিয়ে বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। শুধু আমার না, কারোই অসুবিধা হয়নি।
ভিডিওটি দেখতে ভিজিট করুন : দিনের পর দিন আমাদের দেখা নেই, সাক্ষাৎ নেই , কথা নেই। কিন্তু কেন ?
বীথি যার সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আমার বড় বোনের খালাতো ননদ। বড় আপুই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার পছন্দের কেউ আছে কিনা! আমার পছন্দের কেউ নেই। বাবা - মা, ভাই - বোন যাকে পছন্দ করবে তাকেই বিয়ে করবো। আমার শুধু একটা নিদিষ্ট চয়েজ আছে। আমার যে বউ হবে তার একটি নিজস্ব পরিচয় থাকা লাগবে। অমুকের মেয়ে, তমুকের বউ, কামালের মা নয়। আমার বউয়ের আলাদা একটা পরিচয় থাকবে। আর, মানুষের পরিচয় তার কর্মের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। শিক্ষক হোক কিংবা ডাক্তার কিংবা কেরানি আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তাকে তার পছন্দের যে কোন পেশায় যুক্ত থাকতে হবে। অর্থাৎ, তাকে চাকরি করতে হবে।
এই কথা শুনে সবার মাথায় হাত। কারণ আমাদের বাড়ির কোন মেয়ে চাকরি করে না। করে না কথাটা ভুল, করতে দেওয়া হয় না। কারণ আমাদের ঘরের কর্তা মানে বাবা মনে করেন যে টাকা ইনকাম করে তারই শুধু উচ্চস্বরে কথা বলার অধিকার আছে। যে টাকা ইনকাম করে তারই অধিকার আছে হুমুক করার এবং অন্যের উপর নিজের পছন্দ, অপছন্দ চাপিয়ে দেওয়ার। ঘরের মেয়েরা যদি টাকা ইনকাম করতে শুরু করে দেয় তাহলে তাদের উপর খবরদারি করা যাবে না। যখন তখন খাবারের আর পরনের খোঁটা দেওয়া যাবে না। যখন তখন ঘর থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া যাবে না। আর , মেয়ে মানুষ সবসময় পুরুষের কথায় উঠবে আর বসবে এটাই তাদের কাজ। এই কারণে বাবা আমাদের ঘরের কোন মেয়েকে চাকরি করতে দেয় না। তবে পড়াশোনা করতে দেন। আমার দুই বোন অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর তিনি বিয়ে দিয়েছেন।
ভিডিওটি দেখতে ভিজিট করুন : আমি যখন নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
শ্বশুরের টাকা থাকলে অনেক মেয়ের জামাই ম্যাও ম্যাও করে। আমার দুই দুলাভাই তেমনি। শ্বশুরের সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় রাখতে শ্বশুরের নিয়ম তারা নিজেদের পরিবারেও পরিচালনা করেন। দুই বোনের প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তারা চাকরি করতে পারেনি। সংসার করছে। তবে সংসার জীবনে সুখী। বোনের জামাইরা চাকরি করতে না দিলেও বোনদের সুখে রেখেছে। আমার মা দারুণ গান করতেন। ছোটবেলা বেশ কিছু পুরস্কারও জিতে নিয়েছিলেন। সবার অনেক স্বপ্ন ছিল গানের জগৎতে মা ভালো একটি অবস্থান তৈরী করে নিবেন।
কিন্তু বিয়ের পর বাবা মাকে বললেন গান করতে ইচ্ছে করলে তার সামনে করতে। বাহিরের লোকজনকে গান শোনানোর প্রয়োজন নেই। মায়ের সাথে সাথে তার শুভাকাঙ্খীদের স্বপ্ন সেখানেই শেষ। বড় ভাবী কিছু করতে চেয়েছিলেন কিনা জানা নেই তবে মেজো ভাবী মেডিকেলের ছাত্রী ছিলেন। তাও নিজ যোগ্যতায় সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েছিলেন। ভাবী যখন ইন্টার্নশীপ করছিলেন তখন ভাইয়ার সাথে বিয়ে হয়। একজন মেধাবী ডাক্তার হাসপাতালে না থেকে এখন স্বামী, দেবর আর শ্বশুরের পাশে ডালের বাটি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার দুই ভাই বাবার সাথে ব্যবসা দেখে। বাবার কথা ছাড়া তারা ডান থেকে কাঁধ বামেও ঘুরাতে পারেন না। আমাদের এই ঘরটা আসলে ঘর না, রোবটের কারখানা। পরিচালনা করেন স্বয়ং বাবা। রিমোট কন্ট্রোল তার হাতে। সে যখন যাকে যেভাবে ইচ্ছে কন্ট্রোল করেন।
ভিডিওটি দেখতে ভিজিট করুন : ডাবের পানির উপকারিতা জানেন?
বছরের পর বছর মা কিভাবে এর লোকের সাথে সংসার করে যাচ্ছে ভেবেই আমার সারা শরীরে কাঁটা দিলো। ভাই - ভাবীদেরও পুতুল বানিয়ে রেখেছে। একজন তার বিপক্ষে মুখ খোলার সাহস পেলো না ? নাকি এই আলিশান জীবনযাপন ছেড়ে দিতে হবে সেই ভয়ে কেউ কিছু বলেনি ? এইরকম রোবটিক জীবনযাপনের থেকে এক বেলা ভাত কম খেয়ে সাধারণ জীবনযাপন অনেক ভালো। অন্ততপক্ষে আমার তাই মনে হয়। আমার বাবার আদেশ এই বাড়ির বউ চাকরি করতে পারবে না। বিয়ের ক্ষেত্রে আমার শর্ত আমার বউকে চাকরি করতে হবে। বাবার আদেশ না মানলে আমাকে এই পরিবার এবং বাড়ি ছাড়তে হবে। আর, আদেশ মানলে আমি একটা আলিশান জীবন পাবো কিন্তু রোবটিক। কী করবো ভাবতে হবে!
' সময় অনেক এগিয়েছে, বাবা। মেয়েরা চাকরি করলে সমস্যা কোথায় ? '
' তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। তাছাড়া, সময় যতই এগিয়ে যাক আমার বাড়ির কোন মেয়ে চাকরি করবে না। '
' একটা অযৌক্তিক নিয়ম কেন সবাইকে মেনে চলতে হবে ? '
' তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর দিবো না। '
ভিডিওটি দেখতে ভিজিট করুন : বিখ্যাত মনীষীদের উক্তি ১
' আপনি যা করছেন সেটা অন্যায় করছেন। আপনার পছন্দ অপছন্দ মেনে নিয়ে কেন সবাইকে জীবনযাপন করতে হবে ? অন্যদের নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ থাকবে না ? আপনি কি জানেন আপনি একজন মানসিক অত্যাচারী লোক ? সবার উপরে সারাক্ষণ মানসিক অত্যাচার করে বেড়াচ্ছেন। কেন এইরকম করেন আপনি ? কেন বাবা ? '
আমি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললাম। মা আমাকে বাঁধা দিতে আসলো। বড় ভাবী বারবার থামতে বললো। আমি কারো কথা শুনলাম না। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে গেলাম।
' আমি অত্যাচারী লোক ?'
ভিডিওটি দেখতে ভিজিট করুন : ব্যায়াম ছাড়াই ওজন কমাবে তোকমার দানা
' হ্যাঁ! আপনি মানসিক অত্যাচারী লোক। কেন মা - ভাবীরা আমাদের সাথে একসাথে বসে খেতে পারবে না ? খাবার সার্ভ করার লোক ঘরে নেই ? কেন আমরা পরিবারের সবাই একসাথে বসে খেতে পারি না, বাবা ? ঘরের বউয়ের হাতে রান্না খেতে আপনি পছন্দ করেন। মেনে নিলাম কিন্তু সেটা কেন সবসময় এবং সব পরিস্থিতিতে ?
কোন একদিন মা / ভাবীর রান্না করতে ইচ্ছে নাই করতে পারে! এমন হতে পারে না সেদিন তাদের রান্না করতে ইচ্ছে হলো না ?
কিন্তু সেই দিনটা তারা কেন পায় না ?
যদি কেউ চাকরি করতে না চায় সে করবে না। কিন্তু যে মেয়ে বা বউ চাকরি করতে চাচ্ছে তাকে কেন বেঁধে রাখা হচ্ছে ?
কেন বাবা ? '
' খুব কথা শিখেছো তুমি ? প্রতিবাদী হয়ে উঠেছো ? বিদেশে পড়াশোনা করে দারুণ উন্নতি হয়েছে তোমার। ভুলে গিয়েছিলাম তুমি তো উকিল; বাবাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছো। '
ভিডিওটি দেখতে ভিজিট করুন : গরমে ঠান্ডা পানি খেলেই কেন বিপদ ?
' যেখানে অত্যাচারী লোক থাকে সেখানে কাউকে না কাউকে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হয়। না হলে ইতিহাসের পাতায় কখনো অত্যাচারীর পতনের গল্প লেখা হতো না।
না বাবা! আমি আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাইনি। আপনি একটা অন্যায় কনসেপ্ট নিয়ে চলছেন, আমি সেটা ধরিয়ে দিতে চাচ্ছি। '
' তোমার কাছ থেকে আমাকে ন্যায় - অন্যায় শিখতে হবে ? '
' প্রয়োজনে শিখবেন। সমস্যা তো নেই। '
' তুমি যে বেয়াদব এটা কি জানো ? '
' তারেক তো ভুল কিছু বলেনি, বাবা। তাছাড়া সে কোন বেয়াদবিও করেনি। যে কথাটা আমরা কেউ সাহস করে বলতে পারিনি সেটাই তারেক আজ বলছে। সে কোন অযৌক্তিক প্রশ্নও আপনাকে করেনি। '
মেজভাবী খুব ভদ্রতার সহিত কথাগুলো বললেন।
ভিডিওটি দেখতে ভিজিট করুন : অপূর্ণতার ডায়রি - ১
' বাবা, নিশিকে চাকরি করতে দিতে আমার কখনো আপত্তি ছিলো না। আপনার ভয়ে কখনো সেই কথা আমি বলতে পারিনি। প্রতি রাতে নিশি আফসোস করে আর কাঁদে, আমি পাশে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এসি রুমে বসেও আমি ঘামি, দামি খাটে শুয়েও আমি ঘুমাতে পারি না। একজন মেয়ে এতো কষ্ট করে পড়াশোনা করে ডাক্তার হয়ে শুধুমাত্র আপনার নিয়মের কারণে ঘরে বসে আছে। মেয়েরা চাকরি করলে সমস্যা কোথায় ? '
মেজো ভাইয়া বললেন। আমি শুরুটা করে দিয়েছি। একে একে সবাই মুখ খুলছে। অনেকদিন ধরে সবার মনে অনেক অভিমান জমেছে। আজ সব নিংড়ে দেওয়ার দিন।
' চাকরিজীবী মেয়েরা সংসারী হয় না। চাকরি করলে মেয়েদের পাখা গজায়। পুরুষদের কথা শুনে না। '
' কে বলেছে তোমাকে ? কোন বইয়ে লেখা আছে চাকরিজীবী মেয়েদের সংসার হয় না ? মেয়েদের পাখা গজায় বলতে তুমি কী বুঝলে ? আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী মেয়েরা নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেটাকে ? আর, পুরুষদের কথা শোনে না বলতে কী বুঝলে ? পুরুষরা তখন খাওয়ার আর পরনের খোঁটা দিতে পারে না, চাইলেই বাসা থেকে বের করে দিতে পারে না সেটাকে ? ' মা জিজ্ঞেস করলেন।
' বাব্বাহ! সবার মুখে কথা ফুটেছে। ভিতরে ভিতরে সবাই দেখি প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। '
ভিডিওটি দেখতে ভিজিট করুন : অপূর্ণতার ডায়রি - ২
' চাকরি করার ইচ্ছে আমার কখনো হয়নি সত্যি। তবে নিজের সংসারে সবসময় ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকতে হবে এটা কখনো ভাবিনি। শ্বশুর - শ্বাশুড়ি, স্বামী -দেবরের পাশে বসে একইসাথে খেতে পারবো না এটা কখনো ভাবিনি। তরকারিতে ঝাল কম, নাকি লবণ বেশি হলো এই ভয়ে দিন রাত পার করে দিতে হবে ভাবিনি। বউ হয়ে সংসার করতে এসেছি, কয়েদি হয়ে জেল খাটতে নয়। ' বড়ভাবী বললেন।
' আমি ব্যবসায়ী হতে চাইনি, বাবা। শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম। কলেজের লেকচারার। তোমার ভয়ে কখনো সেই কথা বলতে পারিনি। ব্যবসায়ী বললে ভুল হবে আমরা তোমার হুমুকের গোলাম। তুমি যা বলো সেভাবেই চলি। মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষ হয়ে না, পুতুল হয়ে বেঁচে আছি। ' বড় ভাইয়া বললেন।
' ভালো ভালো খুব ভালো! খুব সুন্দর সিনেমা হচ্ছে আমার বাড়িতে। দুই কন্যা আর তাদের দুই জামাইকেও ডাকো। তাদের মনে কী আছে সেগুলোও শুনি। আমি অত্যাচারী, অপরাধী। আমাকে তোমার শাস্তি দাও, ফাঁসি দাও। '
' আপনি উত্তেজিত হবেন না, বাবা। কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করুন। '
'চুপ করো, তারেক। তুমি আমার সাথে কোন কথা বলবে না। আমার সামনে আসবে না। '
ভিডিওটি দেখতে ভিজিট করুন : লেবুর খোসার উপকারিতা জানুন
'বাবা!'
' যার যা ইচ্ছে সে তাই করুক। আমি আর কাউকে কিছু বলবো না। তবে আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার নিয়ম মানতে হবে। এটা আমার রাজ্য, আমি এখানের রাজা। আমার রাজ্যে আমার আদেশই শেষ আদেশ। এর উপরে কোন কথা হবে না। '
বাবা শেষ কথাগুলো বলে নিজের রুমে চলে গেলেন। আমরা সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকালাম। পরিস্থিতি হালকা করতে আমি একটু হাসলাম।
তারপর বললাম, ' অনেকদিনের নিয়ম ভাঙতে সময় লাগবে। তবে ভাঙা যাবে। প্রথম আঘাতেই মুখ দিয়ে বের হলো যার যা ইচ্ছে সে তাই করুক। ধীরে ধীরে সব হবে। রাজ্য উনারই থাকবে তবে সাজাবো আমরা সবাই মিলে। তোমরা সবাই রাজি ? '
' রাজি মানে ১০০বার রাজি। ' মা ছাড়া সবাই একসাথে বলে উঠলো। আমি মায়ের কাছে গেলাম। মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
ভিডিওটি দেখতে ভিজিট করুন : নাক ডাকার কারন ও সমাধান
' বাবার সাথে এভাবে কথা বললাম বলে তুমি রাগ করেছো, মা ? '
' না বাবা! এতদিন ভাবতাম মানুষটার মনের গোঁড়ামি কখনো দূর হবে না। এই আফসোস নিয়েই হয়তো মরে যেতাম! আজ শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে আল্লাহ তোকে পাঠিয়েছেন উনার মনের গোঁড়ামি আর আমার আফসোস একইসাথে দূর করতে। আই এম প্রাউড অফ ইউ মাই সান '
আমি কাঁদছি, মা কাঁদছে, ভাই - ভাবীরাও কাঁদছে। আমরা সকলে আনন্দে কাঁদছি। অত্যাচারীর খোলস থেকে আমরা আমাদের বাবাকে বের করে নিয়ে আসবো।