ছোটগল্প : লড়াই  

  • ফারজানা আক্তার
  • জুলাই ১০, ২০২১

' ভদ্রলোক এবং তার পরিবারকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না ? ' 

' অবশ্যই যায়। তার আগে বলো তোমার কাছে ভদ্রলোকের সংজ্ঞা কী ? '

আমি আর হাবিবা মুখোমুখি বসে আছি। তাকে আমি হাবিবা আপা বলে ডাকি। আমাদের দুইজনের সামনে দুইটা কফির কাপ। কফি শেষ অনেকক্ষণ।  কিন্তু আমাদের গল্প চলছে। ঠিক গল্প না। পরিকল্পনা চলছে। কিভাবে শূন্য হাতে, শক্ত মনোবল নিয়ে  রাঘব বোয়ালদের সাথে লড়াই করতে হবে সেই পরিকল্পনা ।  এই শহরের কোথাও যখন আমি ঠাঁই পাইনি তখন সে আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো। এই হাবিবা আপা সেদিন শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, ' আপনার কিচ্ছু হয়নি, কিছু হবে না। আমি আছি। আমাকে ভরসা করুন। মনে সাহস রাখুন। '

সেদিনই শেষবারের মতো তিনি আমাকে আপনি বলে সম্মোধন করেছিলেন। তারপর থেকে ' তুই ' বলে সম্মোধন করেন। জীবনের চরম দুঃসময়ে হাবিবা আপা আশার আলো হয়ে এসেছেন। সেই আলোতে আমি এখনো পথ চলছি।  এই ' আমি আছি ' ছোট্ট দুইটা শব্দ শোনার জন্য আমি শহরের অলিতে গলিতে পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। বাবার বাড়ি গিয়েছি, মায়ের হাতে  - পায়ে ধরেছি, বোনদের কাছে হাত জোর করেছি, শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছি, বন্ধু - বান্ধব, আত্মীয় - স্বজন সকলের কাছে গিয়েছি। 

ভিডিওটি দেখুন  :  ভেজানো কিশমিশ শরীরের জন্য কতটা উপকারী ?

কেউ আমাকে ঠাঁই দেয়নি।  যারা দিয়েছেন তারাও এক দুইদিনের জন্য। তাদেরই বা দোষ দিয়ে লাভ কী! যে ভুল আর অন্যায় আমি করেছি তার মাশুল আমাকেই দেওয়া উচিত। তাদের জায়গা থেকে তারা যা করেছেন ঠিক করেছেন। শুধু ঠিক করেনি সেই প্রতারক আর তার পরিবার। 

আমি খুশবু। বাবা মায়ের বড় মেয়ে। আমরা পাঁচ বোন। সবাই পিঠাপিঠি। কোন ভাই নেই। বাবা একজন মুদি দোকানদার। সংসারে আর্থিক টানাপোড়ন লেগে থাকে। আমি তখন কলেজ শেষ করেছি মাত্র। বাবা মায়ের ইচ্ছে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। অভাবের সংসারের মেয়েদের অতো পড়ে লাভ নেই। তাছাড়া আমার ছোট আরো ৪জন রয়েছে। ওদেরও তো কলেজ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে হবে। 

কিন্তু আমার ইচ্ছে আমি আরো পড়াশোনা করবো। চাকরি করবো। সংসারের দায়িত্ব নিবো। বাবাকে বিশ্রাম দিবো। বাবা সারাজীবন কষ্ট করে গেলেন। এই দুনিয়ায় একটু আরাম - আয়েশ করে যাবেন না ? আমার মায়ের বহুদিনের ইচ্ছে একটা পাকা ঘর হবে। প্রায় তিনি এই কথাটা ছলছল চোখে বলেন। আমি নিজে নিজেকে প্রমিজ করেছি আমার মায়ের একটা পাকা ঘরের ব্যবস্থা করবোই করবো। বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা টিউশনি পেলাম। হেঁটে গেলে খানিকটা সময় লাগে এবং কষ্টও হয়।

কিন্তু আমি যদি রিক্সায় যাতায়াত করি তাহলে টিউশনির টাকা কিছু থাকবে না। রিক্সা ছাড়া ওই পথে যাতায়াতের তেমন ব্যবস্থাও নেই। তাই কষ্ট হলেও আমি হেঁটে সেই টিউশনিটা শুরু করলাম। যে পরিবারে টিউশন পেলাম তারা হিন্দু। পুরো পরিবার মানুষ হিসেবে অসাধারণ ছিল। আমাকে খুব স্নেহ করতো। আমার পড়াশোনার ব্যাপারেও বেশ উৎসাহ দিতো। 

ভিডিওটি দেখুন : ফ্রিজে খাবার সংরক্ষণের জন্য কিছু টিপস

আমার ছাত্রীর নাম আশালতা। তারই কাজিন শুভ্র। পুরো নাম শুভ্র সাহা। পেশায় ব্যবসায়ী ছিল। ব্যবসার কাজে আশালতাদের বাড়ি মাঝে মাঝে আসতো। সেখানেই শুভ্রের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। শুভ্র আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। অনেক মজা করে কথা বলতো। তার সেন্স অফ হিউমার বেশ ভালো ছিল। তার কথা বলার ভঙ্গি অসাধারণ।

ব্যবহারও ভালো। তার সাথে কথা বলতে আমার বেশ ভালো লাগতো। তাছাড়া তার মাঝে কী যেন একটা ছিল যা আমাকে বেশ আকর্ষণ করতো। ধীরে ধীরে আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগলাম। আশালতাকে পড়িয়ে আমি যখন বের হতাম শুভ্র তখন কিছুটা দূরে অপেক্ষা করতো। তারপর আমরা কথা বলতে বলতে বাকি পথটা পাড়ি দিতাম। আমার তখন হাঁটার কষ্ট একদম হতো না। উল্টো মনে হতো পথটা আরেকটু যদি বড় হতো! 

যে কয়টা দিন শুভ্র থাকতো সেই কয়টা দিন আমার বেশ ভালো কাটতো। ও চলে গেলে আমার ভীষণ একলা লাগতে শুরু করলো। আমি বুঝতে পারছিলাম শুভ্রও আমাকে পছন্দ করে। ধীরে ধীরে ধর্ম, বয়স আর আর্থিক অবস্থা ভুলে আমরা প্রেমের বাঁধনে বাঁধা পড়লাম।

এইদিকে আমার বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। দুইদিন পর পর কোন না কোন পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসে। তাদের আমাকে পছন্দ হয়, কিন্তু কোন না কোন বাহানায় আমি না করে দিচ্ছি। আমি শুভ্রকে ভালোবাসি। ওকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না। শুভ্রকে বলার পর ও বললো ওর কাছে চলে যেতে। পরিবার, সমাজ কেউ আমাদের বিয়ে মেনে নিবে না। পরিবারকে বললে অশান্তি ছাড়া আর কিছুই হবে না। উল্টা তখন আমাকে জোর করে যার তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে। শুভ্রের এই কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই। 

ভিডিওটি দেখুন : হৃদরোগ থেকে বাঁচার উপায়

তাছাড়া আমি যে সমাজে বসবাস করি এবং আমার পারিবারিক অবস্থান সব মিলিয়ে বাহিরের কেউ যদি শুনে; আমি কোন হিন্দু ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাচ্ছি আমিসহ পুরো পরিবারকে একঘরে করে দিবে। কিন্তু বাবা - মা, বোনদের ছেড়ে আমি স্বার্থপরের মতো নিজের সুখের জন্য পালিয়ে যাবো ?একদিকে আমার ভালোবাসা, অন্যদিকে পরিবার এবং সম্মান দুইটাই আমাকে বেশ মানসিক পেইন দিচ্ছিলো। শুভ্র আমাকে আশ্বাস দিলো একবার বিয়ে হয়ে গেলে বাকি সব ম্যানেজ করা যাবে।

বিয়ে হয়ে গেলে পরিবার তখন কিছু করতে পারবে না। তারা মেনে নিতে বাধ্য। পরিবারকে ম্যানেজ করে বিয়ে করার থেকে, বিয়ে করে ম্যানেজ করা সহজ। কেন জানি না সেই মুহূর্তে শুভ্রকে আমাকে বেশ আপন মনে হলো। ওকে বিশ্বাস করা যায়, ওর উপর ভরসা করা যায় এমন মনে হলো। আমি সেই রাত্রে শুভ্রের কাছে পালিয়ে গেলাম। একবার আমার ধর্মের রীতিতে, তারপর ওর ধর্মের রীতিতে আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। শুভ্রের বন্ধুরা আমাদের বিয়ের সাক্ষী। আমার পক্ষের সাক্ষীও ওর বন্ধুরা, ওর পক্ষের সাক্ষীও ওর বন্ধুরা। 

শুভ্রের বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো। শুভ্র নিজেও সফল ব্যবসায়ী। কিন্তু বিয়ের আগে আমি জানতাম না তার কিসের ব্যবসা। আমি শুধু শুভ্রকে জানতাম। তার পরিবার - পরিজন এবং শুভ্রের ব্যাকগ্রাউন্ড কিছুই জানা ছিল না। আশালতার পরিবারকে দিয়ে আমি শুভ্রকে জাজ করেছি। আমার সবথেকে বড় ভুল ছিল এটা।

আশালতার পরিবার ভালো তাই বলে তাদের সকল আত্মীয় - স্বজনরা ওদের মতো ভালো হবে এটা ভাবা বোকামি। এবং আমি এই বোকামিটা করেছি। বিয়ের পর শুভ্র তার নিজের ফ্ল্যাটে আমাকে নিয়ে উঠে। বিয়ের কয়েকটা সাপ্তাহ ভালো কাটে। আমি আমার বাড়িতে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। আমার কণ্ঠ শুনে বাবা - মা, বোনেরা ফোন রেখে দেয়। একদিন আমি বেশ কান্নাকাটি করছিলাম। শুভ্রকে বলছিলাম আমাকে নিয়ে একবার বাড়িতে যেতে। বাবা - মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিলো। সেদিন শুভ্র আমার গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে, ' আমার আর কাম - কাজ নাই। তোর ন্যাকামি সহ্য করার জন্য বিয়ে করছি? বাপ - মায়ের জন্য বেশি টান থাকলে একেবারে চলে যা। '

ভিডিওটি দেখুন :  রক্ত দেওয়ার পর কোন খাবার খাবেন ?

আমি থাপ্পড় খেয়ে আর ওর মুখের ভাষা শুনে ব্যথা ভুলে গেলাম, কেন কাঁদছিলাম সেটা ভুলে গেলাম, আমি কে এবং কী করেছি সেটাও ভুলে গেলাম! ঠিক কতক্ষণ আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে ছিল মনে নেই।

শুধু একটা বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো আমি মস্ত বড় ভুল করেছি এবং সামনে আমার মহা বিপদ। সেদিন থাপ্পড় দেওয়ার কিছুক্ষণ পর শুভ্র বাসা থেকে বের হয়ে যায়। দুইদিন বাসায় ফিরেনি। বাসায় দুইজন সাহায্যকারী। দুইজনই মধ্যবয়স্ক। শুভ্র ওদের খালা - খালু বলে ডাকে। আমিও তাই ডাকি। তারা সম্পর্কে স্বামী - স্ত্রী। কোন ছেলেপুলে নাই। এখানে শুভ্রের ফ্ল্যাট দেখাশোনা করে, নিজেদের মতো করে থাকে। প্রথম রাতে শুভ্র যখন বাসায় ফেরেনি। আমি ওকে অনেকবার কল দিলাম। ফোন সুইচঅফ বলছিল। আমার নিজের ভিতর অস্থির লাগছিলো। খারাপ কিছু হয়নি তো! আমি খালাকে ডেকে ওর বাসার নাম্বার চাইলাম। 

প্রথমে উনারা দিতে চাইলেন না। আমার সবকিছু কেমন ধোঁয়াশে লাগছিলো। আমি খালা - খালুকে একসাথে ডেকে হাত জোর করে সব বিস্তারিত বললাম। কান্নাকাটি করলাম। আমার পরিবার সম্পর্কে বলার পর তাদের মন কিছুটা নরম হলো। 

তারপর তারা যা জানালো! শুভ্র বাবা - মায়ের বখে যাওয়া সন্তান। ওর সামনের সুন্দর চেহারা আর ভালো ব্যবহার দেখে ওকে ভালো মানুষ মনে করার প্রয়োজন নেই। ভিতরে ভিতরে ও খুব ভয়ংকর মানুষ।  শুভ্রের প্রথম স্ত্রী শুভ্রের বাবা মায়ের সাথে থাকে। ছেলে বখে যাচ্ছে বুঝতে পেরে উনারা উনাদের পছন্দে ছেলের বিয়ে দেন।

কয়েকমাস সংসার করে ওই বউয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করে। রাত - বিরাতে নেশা করে বাড়ি ফেরে। বউয়ের গায়ে হাত তুলে। এই নিয়ে শুরু হয় অশান্তি।  তারপর সে এই ফ্ল্যাটে চলে আসে। শুরুতে এটা ভাড়া ফ্ল্যাট ছিল। পরে কিনে নেয় সে। এই খালা - খালুকে শুভ্রের বাবা - মা পাঠায় যেন তারা শুভ্রের দেখভাল করতে পারে এবং তার কর্মকান্ডের আপডেট দেয়। 

শুভ্র দিনকে দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কয়েকদিন পর পর কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়, তারপর প্রতিবার নতুন মেয়ে নিয়ে আসে। মেয়েরা কয়েকদিন থাকে তারপর চলে যায়। 

ভিডিওটি দেখুন : ভিটামিন বি সম্পর্কে জানুন

অন্য মেয়েরা টাকার বিনিময়ে মজা করার জন্য আসে, নাকি আমার মতো প্রতারিত হয়ে আসে সেটা খালা - খালু জানেন না। আমিও জানি না। কিন্তু এখন আমি কী করবো ? কোথায় যাবো ? কিভাবে সবাইকে মুখ দেখাবো ? এ আমি কী করলাম ? আবেগের বশে নিজের জীবন, পরিবারের মান - সম্মান সব শেষ করে দিলাম ?আমি নিজের রুমে চলে গেলাম।

রুমে ঢুকে আমার পুরো গা ঘিনঘিন করে উঠলো। এই রুমে আগে কতশত মেয়ের সাথে ওই প্রতারক রাত কাটিয়েছে।  না জানি আমার মতো আরো কত মেয়ের জীবন , স্বপ্ন নষ্ট করে দিয়েছে। একইসাথে নিজের উপর প্রচন্ড রাগ আর ওই প্রতারকের উপর ঘৃণা হচ্ছিলো। আমি রুম থেকে বের হতে যাবো ঠিক তখনই প্রতারক রুমে ঢুকলো। ওর চেহারাটা দেখে আমার মনে হলো মুখের উপর ইচ্ছেমতো থুথু দেই। কখনো কখনো কিছু ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে হয়। আমি এখন সেটাই করলাম। ইচ্ছেটা দমিয়ে রেখে বাহিরের দিকে পা দিলাম। সে পিছন থেকে এসে আমার এক হাত ধরে টান দিয়ে, অন্য হাত দিয়ে দরজাটা লক করে দিলো। আমি তাকে বললাম বাহিরে যাবো। সে আমাকে বললো, ' বাহিরে যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করবো। এখন তুমি বউয়ের দায়িত্ব পালন করো।  '

সেদিন আমি নিজের স্বামীর কাছে প্রথম ধর্ষিত হলাম। ওই একই রুমে, একই বিছানায় এবং ওই একই মানুষটার সাথে আমি দুইদিন আগে শরীরের যে ব্যাপারগুলো উপভোগ করছি, সেদিন সেগুলো নরক যন্ত্রনা দিচ্ছিলো।

মনে হচ্ছিলো দুনিয়াতে আমাকে নরকবাস দেওয়া হয়েছে। এর থেকে মৃত্যু শ্রেয়। তার তেষ্টা না মেটা পর্যন্ত সে কাজ চালিয়ে গেলো। আমার কোন বাঁধা, জোর - আপত্তি সে পাত্তা দিলো না। একটা সময় পর আমার বাঁধা দেওয়ার শক্তিও থাকলো না, আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম। নিজ পায়ে কুড়াল মারার কথা শুনেছি। এই প্রথম আমি নিজের পায়ে কুড়াল মেরে আগুনে ঝাঁপ দিলাম। ওই পাষন্ডটা যখন ঘুমাচ্ছিলো আমি তখন তার বাবা - মাকে ফোন দেই । তাদের সব জানালাম। তারা উল্টো আমাকে লোভী, চরিত্রহীন বলে গালাগাল দিলো। আমি টাকার বিনিময়ে তাদের ছেলের সাথে ফুর্তি করেছি।  এখন আরো বেশি টাকার লোভে মিথ্যা গল্প বানিয়ে বলছি। 

ভিডিওটি দেখুন : বেলের উপকারিতা...

একদিকে শরীরের ক্লান্তি, অন্যদিকে মানসিক এতো প্রেশার আমি নিতে পারলাম না। মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। খালা - খালু মাথায় পানি দিয়ে রুমে  দিয়ে গেলেন। ওই জানোয়ারটার পাশে শুইতেও ঘৃণা লাগছিলো। আমি নিচে শুইলাম। নিজের জীবনের ঝড় নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম।

প্রচন্ড ধাক্কায় আমার ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে দেখি সেই জানোয়ার আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিলো আমাকে তখনই খুন করে ফেলবে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগে আমার  নাকে মুখে ইচ্ছেমতো ঘুষি, চড় - থাপ্পড় দিতে লাগলো। আর চিৎকার করে বলতে লাগলো, ' আমার বাবা - মায়ের কাছে নালিশ করিস ? তোর এতো বড় সাহস ? দেখি তোর কোন বাপ কী করে! তোর এমন অবস্থা করমু সমাজে মুখ দেখাতে পারবি না। দেখ কী করি তোর! 'তেমন কিছু বুঝতে না পারলেও এতটুকু বুঝতে পারলাম তার বাবা - মা শাসন করার বদলে ছেলেকে আরো উস্কে দেয়। ছেলেকে সঠিকপথে নেওয়ার বদলে ছেলের নানান কর্মকান্ডে সাপোর্ট দেয়। 

সাপোর্ট বলতে আমি বলছি না তারা ছেলেকে অন্যায় করতে বলে। আমি বলছি ছেলে অন্যায় করে জেলে গেলে, জরিমানা হলে সেসব তারা তাদের টাকা আর ক্ষমতা দিয়ে ধামাচাপা দিয়ে দেয়।

ছায়ার মতো এই কুলাঙ্গার ছেলেকে আগলে রাখছে। যে অন্যায় করে আর যারা অন্যায়কারীকে সাহায্য করে তারাও তো সমান অপরাধী, তাই না ?আমি খুব অসুস্থ আর একইসাথে ক্লান্ত ; চড় - থাপ্পড় খেয়ে মুখে কোন কথা না বলে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম। কারো ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে দেখি খালা আমাকে ডাকছেন। আমি তার সাহায্য নিয়ে উঠে বসলে তিনি আমাকে বলেন আমি যেন পালিয়ে যাই।  তা না হলে যে কোন সময় আমি খুন হয়ে যাবো। আমি কাঁদতে কাঁদতে খালাকে বললাম কোথায় যাবো! আমি তো নিজ হাতে সকলকিছু শেষ করে দিয়েছি। খালা বললেন তার এক বোনের বাড়ি আছে। কয়েকদিন আমার সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন। খালাকে আমার তখন বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল মনে হলো। খালা আমাকে নিজে পৌঁছে দিবেন সেই ভরসা দিলেন। 

খালার ভরসায় আমি তার বোনের বাড়ি গেলাম। কয়েকদিন যাওয়ার পর শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলাম। খালার বোন মানুষ হিসেবে ভালো, কিন্তু তার স্বামীকে আমার বেশি সুবিধার মনে হলো না। 

ভিডিওটি দেখুন : দাঁড়িয়ে পানি পান ক্ষতিকর যেসব কারণে

তাদের দুই মেয়ে। বিয়ে দিয়েছেন। তারা শ্বশুরবাড়ি থাকে। এই বাড়িতে খালার বোন আর তার স্বামী থাকেন। এক রুমের বাসা। খাটে তারা ঘুমান, আমি ফ্লোরে। রাতে আমার বেশ অস্বস্তি হয়। একদিন দুপুরবেলা আমি খালাকে বলে কিছু টাকা ধার নিয়ে নিজের বাবার বাড়ি যাই। আমি স্বীকার করছি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি। তারা তো আমার জন্মদাতা পিতা - মাতা। আমি ক্ষমা চাইলে আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না ?কিন্তু আমার বাবা আমার মুখ দেখলেন না। আমার মা স্বামীর কথায় সায় দিলেন।

বোনেরা বললো আমার কারণে তাদের ভালো জায়গায় বিয়ে হবে না,  পাড়ার মানুষ ছিঃ ছিঃ করছে। তারা আমাকে কখনো ক্ষমা করবে না। বাবার বাড়ি থেকে ফিরে আবার খালার বাড়ি আসি। শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে তাদের কাছে যাই। তারা আমাকে পতিতা, ব্ল্যাকমেইলার অপবাদ দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। থানায় আমাকে নিয়ে যাওয়ার পর আমি চিৎকার করে বলতে থাকি আমি পতিতা নই, আমি চরিত্রহীন নই, আমি ব্ল্যাকমেইলার নই, আমি লোভী নই। আমি বোকা, আমি গাঁধা, আমি অন্ধ, আমি সহজ সরল প্রেমিকা, আমি একজন প্রতারিত বউ, স্বার্থপর মেয়ে,  বোন এবং সর্বশেষ অসহায় নারী। 

হাবিবা আপা সেই থানার এসআই । আমার কান্নাকাটি শুনে সে আমাকে তার রুমে ডাকেন। বিস্তারিত সকলকিছু শুনেন।  পুলিশের চোখ অপরাধী আর নিরপরাধ চিনতে ভুল করে না। হাবিবা আপা আমাকে ঠিক চিনতে পেরেছিলেন। সেদিন তার সাহায্যে আমি থানা থেকে মুক্তি পাই।  

এতো বড় শহর কিন্তু আমার যাওয়ার জায়গা নেই। ঘুরেফিরে সেই খালার বাসায় ফিরে গেলাম। কিন্তু একজন মানুষের বাসায় এভাবে কতদিন থাকবো ? এবার নিজের কোন একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দুইদিন পর খালা বললেন তিনি তার বড় মেয়ের বাসায় যাবেন। দুই / তিনদিন থাকবেন। খালুর সাথে এক রুমের বাসায় থাকতে হবে ভেবে ভয়ে আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। এই লোকের তাকানো, হাবভাব আমার পছন্দ না। তাছাড়া যতই একজন খাটের উপর, একজন ফ্লোরে শুই না কেন একইরুমে একা একজন পুরুষের সাথে থাকার কথা কল্পনাও করতে পারি না। 

ভিডিওটি দেখুন : গর্ভাবস্থায় কাঁচা পেঁয়াজ খাচ্ছেন? জানুন বিস্তারিত

আমি খালাকে বলতেও পারছি না তার সাথে যেতে চাই বা খালুর সাথে থাকতে পারবো না। আমি তখন আমার বান্ধবী রিতাকে ফোন করে সবকিছু বলি। রিতার সাথে একসাথে স্কুলে পড়েছি। ওর আগে বিয়ে হয়ে যায়।  ওর নিজেরও এক রুমের বাসা। আমাকে থাকতে দিতে পারবে না সরাসরি বলে দেয়। এভাবে একে একে আমি প্রায় ১০জনকে ফোন করি।

কারো বাসায় ঠাঁই হয়নি। অবশেষে আমার কাজিন রত্না আপা আমাকে তার বাসায় যেতে বলেন। আনন্দে চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছিলো। মনে হয়েছিল আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। ঠিকানা নিয়ে রত্না আপার বাড়ি চলে যাই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই যেভাবেই হোক একটা কাজের ব্যবস্থা করে হোস্টেলে উঠে যাবো। তারপর আমার আজকের এই অবস্থার জন্য যারা দ্বায়ী সেই অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। রত্না আপার বাসায় কয়েকদিন থাকার পর একদিন সে আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি কনসিভ করেছি কিনা! জীবনে হুট করে এতকিছু ঘটে গেলো পিরিয়ডের ডেট সেই কবে পিছিয়েছে খেয়াল করিনি। ও আমাকে প্রেগন্যান্সি কিট বাসায় এনে দেয়। যে ভয় পাচ্ছিলাম সেটাই হলো। আমি কনসিভ করেছি। 

রত্না আপা আমাকে বলেন বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে। নিজেরই থাকা - খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। বাচ্চা জন্ম দিবো কিভাবে ? আমিও ভেবেছি বাচ্চা নষ্ট করে ফেলবো। পরক্ষণে আবার মনে হলো না! একবার নিজের পরিবারকে ছেড়ে পালিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছি। এখন নিজের পেটের বাচ্চাকে নষ্ট করে দ্বিতীয় বড় ভুল করতে চাই না। আমার একাকী লড়াকু জীবনে আল্লাহ একজন সঙ্গী পাঠাচ্ছেন তাকে আমি এভাবে ফিরিয়ে দিতে পারি না।

তাছাড়া যে প্রাণ আমি সৃষ্টি করতে পারবো না, সেই প্রাণ  নষ্ট করার অধিকার আমার নেই। একজীবনে প্রথম ভুলের মাশুল দিয়ে শেষ করতে পারবো না। সেই জীবনে দ্বিতীয় এতো বড় ভুল, একইসাথে অন্যায় করার মানে নেই। এই বাচ্চা থাকবে, আমি রাখবো। আমার কথা শুনে রত্না আপা খুশি হননি। উল্টা আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন তিনি বেশিদিন আমাকে রাখতে পারবেন না। আমার পেটে সন্তান এসেছে।  এই কথা শুনে নিশ্চয় আমার বাবা - মা আমাকে ফেলে দিতে পারবে না। এবার নিশ্চয় ক্ষমা করে দিয়ে বুকে তুলে নিবে। এই আশায় আমি আবার বাবার বাড়িতে গেলাম। 

ভিডিওটি দেখুন : ঘরোয়া উপাদান দিয়ে দূর করুন কনুইয়ের কালো দাগ...

অপমান ছাড়া আর কিছু জুটেনি। বাবার বাড়ি থেকে বের হয়ে একটা পার্কে বসে বাকি সব আত্মীয়, চেনাজানা জায়গায় ফোন দিলাম। না ছাড়া সেদিন আর কোন উত্তর পাইনি। এতবড় দুনিয়ায় আমার পাশে দাঁড়ানোর মতো একটা মানুষ নেই ? এতবড় পাপী আমি ? মনের মধ্যে যখন নানান কথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো ঠিক তখন হাবিবা আপার কথা মনে হলো। এই মেয়েটা সেদিন এক কথায় আমাকে বিশ্বাস করেছিল।

একবার তার কাছে যাবো  ? একটু আশ্রয় চাইবো ? দিবে ? নাকি ধান্দাবাজি মনে করবে! ভাবতে ভাবতে আমি উঠে দাঁড়িয়ে থানার দিকে হাঁটা দিলাম। থানায় গিয়ে হাবিবা আপার  খোঁজ করতে তাকে পেয়ে গেলাম। তাকে বাকি সব কথা বলতে বলতে কেঁদে দিলাম। তিনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আশ্বাস দিলেন , আমি তাকে ভরসা করলাম। হাবিবা আপার কল্যাণে আমি একটা অফিসে রিসেপশনিস্টের চাকরি পেলাম। আপার সাথে আমি ১৫/২০ দিন ছিলাম। তারপর একটা হোস্টেলে উঠলাম। নতুন চাকরি, হোস্টেল গুছিয়ে নিতে নিতে কয়েকটা মাস কেটে গেলো। 

এই শহরে একমাত্র হাবিবা আপার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হয়। আর, সেই খালা যার বাসায় আমি কয়েকদিন ছিলাম তার কাছে মাঝেমাঝে ফোন দেই। উনার কাছ থেকে যে টাকা ধার নিয়েছিলাম সেগুলো কয়েকদিন আগে শোধ করেছি। বাবা - মা, বোনদের সাথে মাঝে মাঝে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি কিন্তু তারা আমাকে চিনতে পারার সাথে সাথে ফোন কেটে দেয়। গতকাল রাতে হাবিবা আপা আর্জেন্ট দেখা করতে বলে।

আজকে তাই দেখা করতে এসেছি। আপা জানান সেই প্রতারক আর তার পরিবার গোপনে মাদকের ব্যবসা করতো। বিভিন্ন কলেজ আর ভার্সিটিতে লুকিয়ে লুকিয়ে তারা ছাত্র - ছাত্রীর হাতে মাদক তুলে দিতো। তাদের বিশাল সিন্ডিকেট রয়েছে। কয়েক বছর ধরে গোয়েন্দারা তাদের উপর নজর রেখে সব তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে অবশেষে পুরো পরিবারকে গ্রেফতার করেছে। শুধুমাত্র শুভ্রের প্রথম বউয়ের বিরুদ্ধে তারা কোন প্রমাণ পায়নি। সে বেচারি নির্দোষ। তার একটা দুই বছরের ছেলে বাবু আছে। 

ভিডিওটি দেখুন :  ব্যতিক্রমী কাজে ব্যবহার করুন কোমল পানীয়...

আমি আপার কথা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। আপা জানালেন গোয়েন্দারা তাদের যত অপকর্মের তথ্য, প্রমাণ জোগাড় করেছে তাতে এই জীবনে জেলের বাহিরে পা রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। আমি আর এখন মামলা করবো কিনা আপা জিজ্ঞেস করলেন!

' অবশ্যই মামলা করবো। ' আমি বললাম। 

' ওরা এখন ওদের শাস্তি পাবে। তুই এখন নিজের ক্যারিয়ার আর অনাগত বাচ্চাটাকে নিয়ে ভাব। এদের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দে।  '

' না আপা! মাদক নিয়ে কারবার করেছে তার শাস্তি তারা পাবে। আমার জীবন নিয়ে খেলেছে, আমার সাথে প্রতারণা করেছে, তার পরিবার অন্যায় করেছে এর শাস্তি আলাদা। দুইটা বিষয় এক নয়। '

আমি জানি ক্ষমা মহৎ গুন্। কিন্তু আমি এতোটাও মহৎ নই যে লোকটা আমাকে টিস্যুর মতো ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলেছে, আমার পরিবার থেকে আমাকে আলাদা করে দিয়েছে, যার পরিবার আমাকে পতিতা অপবাদ দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে , তাদের ছেলে আমার সাথে কী করেছে সেটা জেনেও না জানার ভান করেছে, আমার অনাগত সন্তানকে অনিশ্চিত ভবিষৎতের দিকে ফেলে দিয়েছে তাকে এবং তাদেরকে ক্ষমা করে মহৎ হতে চাই না। 

আজকে আমি ক্ষমা করলে কাল আবার আরেকজন নারীর অবস্থা ঠিক আমার মতো হবে। ওদের এই নোংরামি এখানেই বন্ধ উচিত। আমি আজকেই মামলা করবো। আর, দেরি নয়। তারপর আপা বললেন, ' ভদ্রলোক এবং তার পরিবারকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না ? ' 

আমি যখন ভদ্রলোকের সংজ্ঞা জানতে চাইলাম আপা চুপ করে রইলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ' চল থানায় যাই। ' 

আমি আর আপা থানার দিকে হাঁটছি। সাথে আছে আমার অনাগত সন্তান। যে পৃথিবীতে আসার আগেই তার মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চলছে। 

ভিডিওটি দেখুন :  ভ্যাসলিনের ১০টি চমৎকার ব্যবহার জেনে নিন...

 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment