ছোটগল্প : তিন কন্যা

  • ফারজানা আক্তার
  • জুলাই ১৪, ২০২১

' এই দেশে আর কোন বাড়ি নেই ? ওই বাড়িটাই কিনতে হবে ? '

' এই দেশে অনেক বাড়ি আছে, কিন্তু আমাদের ওই বাড়িটা লাগবে। '

' মা! তুমি এখনো রেডি হওনি ? '

' কই গো! বাবুর আব্বু শুনছো ? তোমার আর কতক্ষণ লাগবে ? '

' আপা! দুলাভাই এতো অলস কেন ? তুই কিছু বলিস না ? '

' আম্মু! আম্মু! আমি এই লাল জামাটা পরি ? '

' ছোটমণি! তুমি আমার জন্য লাল জামা কিনো নাই ? '

আজকে সকাল থেকে এই হচ্ছে আমার বাসার অবস্থা। তিন মেয়ে, মেয়ের জামাই আর নাতনিরা এসেছে। পুরো ঘরে আমার ঈদের আনন্দ বয়ে যাচ্ছে। 
অতবড় আকাশে মাত্র একটা চাঁদ। আর, আমার ছোট্ট এই বাসায় আজ চাঁদের মেলা বসেছে। আকাশের চাঁদ শুধু রাতে আলো দেয়। আমার ঘরের চাঁদেরা আমাকে সারাক্ষণ তাদের আলোয় আলোকিত করে রাখে। 

ভিডিওটি দেখুন : মাসিকের সাথে মাথাব্যথার কোন সম্পর্ক আছে ?

তিন মেয়ের একজন ডাক্তার, তার স্বামী সরকারি উকিল এবং তাদের একমাত্র মেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে। মেজো মেয়ে ইউনিভার্সিটির টিচার, তার স্বামীও ইউনিভার্সিটির টিচার। স্বামী -  স্ত্রী দুইজনেই কলিগ। তাদের দুই মেয়ে। একজন ক্লাস টুতে পড়ে, অন্যজন এখনো স্কুলে যায় না। 

ছোট মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার, তার স্বামী ডাক্তার। ছোট মেয়ের জামাই বড় মেয়ের বন্ধু। বড় মেয়ের বিয়েতে তাদের আলাপ হয়। সেই আলাপ টেনে একদম বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছে। তাদের এখনো কোন বাচ্চা হয়নি। প্ল্যানিং চলছে। আমি আশা। একজন সিঙ্গেল মাদার। শুধুমাত্র তিন মেয়ের জন্ম দিয়েছি বলে আমাকে স্বামীর সংসার ছাড়তে হয়। আমার শাশুড়ি বলেছিলেন আমার পেট নাকি কয়লার খনি! ওই কয়লার খনি থেকে কখনো ছেলে সন্তান জন্ম নিবে না। 

ভিডিওটি দেখুন :  পিরিয়ডের ব্যাথা দূর করার উপায় জানুন

কোন এক অজানা কারণে আমার শাশুড়ি মেয়ে সন্তান পছন্দ করতেন না। যদিও তিনি নিজে একজন মেয়ে, এবং তার নিজেরও ৫ মেয়ে। তবুও তিনি মেয়ে সন্তানকে অভিশাপ মনে করতেন। তার কাছে মেয়ে সন্তান মানে ওদের খায়িয়ে, পরিয়ে বড় করে আবার অনেক টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া। বিয়ের পর মেয়েরা পর হয়ে যায়। নিজের বাবা - মাকে ছেড়ে অন্যের বাবা - মায়ের সেবা যত্ন করে। তাছাড়া কয়টা মেয়ে নিজের বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে ? যা করার ওই ছেলেরাই করে। 

ছেলে সন্তানেরা বড় হয়ে ইনকাম করে। বড় চাকরি করে বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে। নিজের বাবা - মায়ের দেখা শোনা করে। মরে গেলে নিজেরা কাঁধে করে কবরে নিয়ে গিয়ে মাটি দেয়। আর এই মেয়েরা বাবা - মায়ের জানাজাও পড়তে পারে না, আবার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়াও করতে পারে না। 

মেয়েরা বাবা - মায়ের শুধু খরচ বাড়ায়। এইছাড়া অন্য কিছু পারে না। আমার প্রাক্তন স্বামীরা ৩ ভাই, ৫ বোন ছিলো। আমার স্বামী সবার ছোট। আমি ছোট বউ ছিলাম। বড় দুই জা ছেলে সন্তান জন্ম দিয়ে বেঁচে গেছেন। না হলে আমার মতো ওদেরও ঘর ছাড়তে হতো। 

ভিডিওটি দেখুন :  স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতন হন

আমার প্রাক্তনের ৫ বোনের মধ্যে যাদের ছেলে সন্তান আছে তাদের কদর আলাদা। যাদের ছেলে সন্তান নেই তাদের অবস্থা ভয়াবহ। শ্বাশুড়ি নামের সেই ভদ্র মহিলা ছেলের বউ বলে শুধু আমার সাথে অন্যায় করেননি,উনার নিজের পেটের মেয়েদের সাথেও অন্যায় করেছেন। 

সবসময় তিন ছেলেকে ভালো কাপড়, ভালো খাবার, আলাদা যত্ন করেছেন। তিন ছেলে মায়ের আঁচলের নিচে থেকে থেকে অপদার্থ হয়েছে। মায়ের অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা টু শব্দ করার শক্তি কোন ছেলের নেই। বউয়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে দূরের কথা! নিজেদের বোনদের সাথে যে অন্যায় করা হয় তার সামান্য প্রতিবাদ করতে পারে না। কপালগুনে সেই ৫ বোনের স্বামীরা ভালো মানুষ। আল্লাহ একদিকে কম দিলেও, অন্যদিকে ভরপুর দিয়ে দেন। অন্যথায় মানুষ বেঁচে থাকতো কিভাবে ?

শ্বাশুড়ি নামের সেই ভদ্রমহিলার বাবা ছিলেন বিরাট ধনী মানুষ। এই দিকে শ্বশুর মশাইয়ের মাশাআল্লাহ কম নেই। ভদ্রমহিলা নিজের বাবার কাছ থেকে অনেক জমিজমা এবং ক্যাশ টাকা পেয়েছিলেন। টাকা পয়সার অভাব তাদের ছিলো না। 

ভিডিওটি দেখুন :  সাদাস্রাব নিয়ে সমস্যায় আছেন ?

তবুও শুধু মেয়ে হবার অপরাধে তিনি  নিজের পেটের মেয়েদের খাবারে কষ্ট দিয়েছেন, কাপড়ে কষ্ট দিয়েছেন। সাথে মানসিক কষ্ট তো ফ্রি ছিলো। শ্বশুর মশাই ছিলেন বলে তবুও রক্ষে ছিলো। তা না হলে কী যে হতো!এইজন্য শ্বশুর মশাই তাড়াহুড়ো করে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। স্বামীর বাড়িতে গিয়ে এই পাঁচজন মেয়ে যেন একটু সুখের মুখ দেখে! শ্বশুর মশাইয়ের দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন। তার মেয়েরা ভালো আছে। 

আমি বউ হয়ে যাওয়ার এক বছর পর শ্বশুর মশাই মারা যান। সেই বছরই বড় মেয়ে পেটে আসে। বউ হয়ে যাওয়ার পর ওই বাড়িতে সারাক্ষণ আতংকে থাকা লাগতো। শ্বাশুড়ির মুখের উপর কারো কিছু বলার নেই। সংসারে উনার কথাই একমাত্র কথা। সকালে কী রান্না হবে, দুপুরে সবাই কখন খাবে, রাতে কার প্লেটে কী যাবে সব উনি দেখতেন। 

বাবা - মা দেখেশুনে ভালো বর আর বড় বাড়ি দেখে বিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু বড় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পেট ভরে খেতেই পারি না। শ্বাশুড়ি বলেন বিয়ের পর পেট ভরে খেলে মেয়েমানুষ মোটা হয়ে যায়। সবসময় পেটের তিনভাগের দুইভাগ খালি রেখে মেয়েদের খেতে হয়। মেয়েরা হবে সঞ্চয়ী, খাই খাই স্বভাবের মেয়েদের সংসারে উন্নতি হয় না। 

ভিডিওটি দেখুন :  গর্ভাবস্থায় সকালের দিকে খুব বমি হয় ?

শ্বাশুড়ির চিন্তা - ভাবনা এবং কথা - বার্তা এতটাই ভিত্তিহীন ছিল বাপের বাড়ি বা বাহিরের কাউকে লজ্জায় বলতে পারতাম না। ঘরের ছেলেরা আয় রোজগার করে তাই তারা ভালো খাবার পেট ভরে খাবে। মেয়েরা সারাদিন ঘরে বসে শুয়ে থাকে তাই তাদের ভালো খাবারের প্রয়োজন নেই। ঘরের সকল কাজ যেন কোন জ্বিন ভুতে করে যেতো!

দুই জা সবসময় ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকতো। আমরা তিন জা কখনো একসাথে বসে গল্পও করতে পারতাম না। বড় জায়ের দুই ছেলে আর ছোট জায়ের এক ছেলে এবং এক মেয়ে। আর, আমার ঘরে জন্ম নিলো একে একে তিন মেয়ে। ছোট মেয়ের জন্ম নেওয়ার ৭ দিন পর আমার শ্বাশুড়ি রুমে এসে আমাকে বলে, ' তোমার বাপের বাড়িতে খবর দাও। তোমারে আইসা যেন একেবারে নিয়া যায়। '   

' একেবারে নিয়ে যেতে বলবো মানে ? '

' আমার বুঝা শেষ। তুমি আমার পোলারে কখনো তার পোলার মুখ দেখাতে পারবা না। তোমার পেট থাইক্যা কখনো পোলা জন্ম নিবো না।  '

'মা! আপনি এসব কী বলছেন ? ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা আমার হাতে নেই। '

ভিডিওটি দেখুন :  গর্ভাবস্থায় বমিভাব বেশি হচ্ছে ?

' যেহেতু তোমার হাতে ক্ষমতা নাই। তুমি তোমার তিন মাইয়া লইয়া যাওগা। আমি পোলারে আবার বিয়া করামু। '

' মা! আপনি কী বলছেন ? ও ভাইয়ারা! মা এসব কী বলছে ? কিগো! তুমি কিছু বলছো না কেন ? ' আমি একে একে ভাসুরদের, শ্বাশুড়ি এবং স্বামীকে প্রশ্ন করলাম। অনেক আকুতি মিনতি করলাম। শ্বাশুড়ি এক কথার মানুষ আর

তার মুখের উপরে কথা বলার মতো মেরুদন্ড এই পরিবারে কারো নেই। আমার মেজো মেয়ে হওয়ার পর তিনি মোটামুটি নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই জন্য তিনি আমাকে তৃতীয় সন্তানের জন্য প্রেশার দেন। আমি তৃতীয় সন্তান নিতে চাইনি। 

শ্বাশুড়ির জোড়াজুড়িতে তৃতীয় সন্তান নিয়েছি। তৃতীয় সন্তান ছেলে হলে আমাকে স্বামীর সংসার ছাড়তে হতো না। যেহেতু আমি আরেকটি কন্যা সন্তানের মা হয়েছি তাই আমাকে এখন এই সংসার ছেড়ে দিতে হবে। আমার জায়গায় নতুন কেউ আসবে এই সংসারে ছেলে সন্তান জন্ম দিতে। 

ওই সংসার ছেড়ে যখন আমি চলে আসি তখন বড় মেয়ের বয়স ৫ বছর, মেজো মেয়ের ৩ বছর ৩ মাস বয়স ছিল। ছোটটার ৮দিন। যেদিন মেয়ের ৭ দিন বয়স সেদিন শ্বাশুড়ি তার ফাইনাল কথা জানিয়ে দেন। পরেরদিন আমার বাবা গিয়ে নিয়ে আসেন। 

ভিডিওটি দেখুন :  গর্ভাবস্থায় নিরাপদ ভ্রমণের কিছু টিপস

যখন চলে আসি তখন এক মেয়ে আমার কোলে, দুই মেয়ে আমার দুইপাশে দাঁড়িয়ে ধরে রেখেছে আর তাদের বাবার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে ছিলো। বাবারা সন্তানদের কাছে সুপারম্যান। সকল বিপদ আপদে বাবারা সন্তানদের আগলে রাখেন। আর, আমার সন্তানদের বাবা নিজের মায়ের আদেশ পালন করতে গিয়ে আমার এবং আমাদের সন্তানদের সাথে ব্যাপক অন্যায় করে ফেললেন। 

আমার বাবা অনেক চেষ্টা করেছেন শ্বাশুড়িকে বুঝানোর। আমি নিজে স্বামীর সাথে অনেকবার কথা বলেছি। উনার এক কথা তার মা নাতি চেয়েছে। তাকে নাতি দিতে হবে। মাকে নাতি দেওয়ার জন্য উনার যা করণীয় উনি তাই করবেন। 

মনের কোণে কোথাও আশার আলো ছিলো আমার স্বামী মানুষটা এমনিতে খারাপ না। আমার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেননি। দুই মেয়েকে এমনিতে আদর করেন। কিন্তু মায়ের ভয়ে কিছু বলতে পারেন না। তিন মেয়েকে এতিম করে দিয়ে তিনি কঠিন কোন সিদ্বান্ত নিবেন না। অবশ্যই কোন না কোন একটা সমাধানের পথ বের করবেন। 

ভিডিওটি দেখুন :  আমি যখন নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

গুনে গুনে ৪ মাস পর একদিন মেয়েদের বাবা আমার বাপের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে আমার আশার আলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। নিশ্চয় তিনি ভালো কোন খবর নিয়ে এসেছেন! কিন্তু সেদিন আমার সেই আশার আলো বেশিদিন জ্বলজ্বল করতে পারেনি। খুব অল্প সময়ে সারাজীবনের জন্য নিভে গিয়েছিলো। 

উনি এসেছিলেন আমাকে ফাইনাল কথা জানাতে। উনি উনার মাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উনার মা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আমাকে নিয়ে সংসার করলে উনাকে ত্যাজ্য করা হবে। সম্পত্তির এক ভাগও পাবেন না।আর, উনি আমাকে বললেন তিন মেয়েকে বড় করে বিয়ে দিলে পর হয়ে যাবে। এরপর বৃদ্ধ বয়সে উনার কী হবে, আমার কী হবে ? সংসারে একজন ছেলে সন্তানের প্রয়োজনীয়তা অনেক। উনি নিজেও নাকি অনেক ভেবে দেখেছেন এই বিষয়টা। 

উনাকে দেখে আমার বড় দুই মেয়ে দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। উনি মেয়েদের হাত ছাড়িয়ে আমাকে কথাগুলো বললেন। উনি যখন মেয়েদের হাত ছাড়ালো আমার বড় মেয়ে দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। অবহেলা সবাই বুঝতে পারে। সে বুড়ো হোক, আর বাচ্চাই হোক। 

ভিডিওটি দেখুন :  বলো আমার কেমন বদল চাও তুমি ?

বড় মেয়ের দেখাদেখি মেজোটাও আমাকে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। ছোটটা তখন ঘুমাচ্ছিলো। সেও ঘুম ভেঙ্গে কেঁদে দিলো। তিন মেয়ে একসাথে কাঁদছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি আর তাদের বাবা ছেলে সন্তানের প্রত্যাশায় আমাদের ছেড়ে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। 

ওই বাড়ি থেকে ডিভোর্স লেটার পাঠালো, আমি রেখে দিলাম। একটা কাগজ সকল সম্পর্ক, স্মৃতি ছিন্ন করে দিলো। শুরু হলো তিন মেয়ে আর বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে আমার নতুন জীবন। আমার দুই ভাই আছে। তিন মেয়েসহ আমার ভরণ পোষণের দায়িত্ব নিতে তারা নারাজ। তাই তারা বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। যাওয়ার সময় সম্পত্তির বেশিরভাগ অংশটুকুই নিয়ে গেছে। এমনকি বাবার পেনশনের টাকার ভাগও নিয়ে গেছে। 

ভাইয়েরা যখন বাবার কাছে টাকা - পয়সা, সম্পত্তির ভাগ চাচ্ছিলো আমি বাবাকে বলেছিলাম তারা যা চায় দিয়ে দিতে। তোমাদের সকল দায়িত্ব আমিই নিলাম। ভাইয়েরা তাচ্ছিল্য করে বলেছিলো, ' আগে নিজের ব্যবস্থা কর। পরে বাবা মাকে দেখিস। '

বাবা - মায়ের কাছে তিন মেয়েকে রেখে আমি সেলাই কাজ শিখলাম আর পাশাপাশি টিউশনি করতে শুরু করলাম। দিনে টিউশনি আর রাতে সেলাইয়ের কাজ করতাম। কিছু টাকা জমিয়ে আমি চারটা ছাগল কিনলাম। আমার মা বললো বাড়ির পাশে ছোট একটা জমি আছে। ঐটা মায়ের নামে। মাটি দিয়ে ভরাট করে সবজি, ফলমূলের গাছ লাগাতে। বাবাও সায় দিলেন। আমি মাকে বললাম তোমার জমিতে গাছ লাগাবো, তবে জমির ভাড়া নিতে হবে। মা হাসলেন এবং বললেন, ' সে সময়ে দেখা যাবে। '

ভিডিওটি দেখুন : অপূর্ণতার ডায়রি - ১

মায়ের জমির ভাড়া আমি শোধ করতে পারিনি। তার আগেই মা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমার লড়াই শুরুর দুই বছরের মাথায় মা আমাদের ছেড়ে চলে যান। ততদিনে আমি দুইজন সহকারী রেখেছি। এইদিকে টিউশনিতে ছাত্র - ছাত্রী বেড়েছে, সেলাই কাজের অর্ডার বেড়েছে , অন্যদিকে গরু কিনেছি , হাঁস - মুরগি কিনেছি। একজন সহকারী সেলাই কাজের জন্য। অন্যজন গরু - ছাগল, হাঁস - মুরগি পাশাপশি সবজির বাগান দেখার জন্য। 

পরিশ্রমী ব্যক্তির সাথে ভাগ্য বেঈমানি করে না। আমি তার প্রমাণ পেয়েছি। আমি যেমন রাত - দিন এক করে খেটেছি। ভাগ্যও আমাকে দুই হাত ভরে দিয়েছে। মেয়েদের ভালো স্কুলে ভর্তি করেছি, টিউশনি বাদ দিয়ে কোচিং সেন্টার খুলেছি। 

ঘরে সেলাই কাজ বাদ দিয়ে বাজারে বড় দোকান ভাড়া নিয়েছি সেখানে ৭/৮ জন কর্মচারী কাজ করে। এইদিকে সময়ের সাথে সাথে গরু - ছাগল, হাঁস - মুরগি, সবজি, ফল বাগান সব পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। কর্মচারী বেড়েছে, নিজের পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থান করেছি, জায়গা কিনেছি। আমার দিন ঘুরেছে সেটা বাবা কিছুটা দেখে গিয়েছেন। কিন্তু আমার দিন ঠিক কতটা ঘুরাতে পেরেছি সেটা পুরোপুরি বাবা দেখে যেতে পারেননি। মা তো কিছুই দেখে যাননি। তবে আমার মনে হয় উনারা প্রতিনিয়ত আমাকে দেখছেন। আমার সাথে সাথে আছেন।

ভিডিওটি দেখুন :  অপূর্ণতার ডায়রি - ২

আমার তিন তিনটা রাজকন্যা পড়াশোনায় যেমন ভালো, ওদের জ্ঞান - বুদ্ধি, ব্যবহারও অতুলনীয়। আমি নিজে গর্বিত এমন তিনজন কন্যার মা হতে পেরে। আমার এলাকায় আমার মেয়েদের জয়জয়কার। এলাকার সবাই খুব স্নেহ করে, ভালোবাসে। আমার দুই ভাই বাঁকা চোখে তাকায়, দূরে দূরে থাকে। মেয়েরা মানুষ হয়েছে, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। আমার সকল ব্যবসা - বাণিজ্য মেয়েদের বুঝিয়ে দিতে চাই কিন্তু ওরা নিতে চায় না। শুধু বলে সময় হলে দেখা যাবে। আজকে এই বাসায় সবাই একত্রিত হয়েছে কারণ তারা আমার জন্য একটা বাড়ি কিনেছে। তিন বোন মিলে একটা বাড়ি কিনে আমাকে উপহার দিয়েছে। সেই বাড়িটা হলো আমার প্রাক্তন শশুরবাড়ি। 

যে বাড়ি থেকে কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, সেই বাড়ি কিনে সেই কন্যা সন্তানেরা আমাকে উপহার দিয়েছে। এখন সবাই মিলে সেই বাড়িতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি। শুনেছি শ্বাশুড়ি নামক ভদ্রমহিলা বেঁচে নেই। বাকি সবাই আছেন। 

আমার দুইপাশে দুই মেয়ে। বড় মেয়ে আর মেজো মেয়ে। আর ঠিক সমানে ছোট মেয়ে। যেদিন বের হয়ে গিয়েছিলাম সেদিনও আমার দুই পাশে বড় মেয়ে আর মেজো মেয়ে ছিল। ছোটটা কোলে মানে সেই হিসেব ধরতে গেলে সামনেই ছিলো। 

কাঁদতে কাঁদতে বের হয়েছিলাম, কাঁদতে কাঁদতেই বাড়িতে পা রাখছি । আগে ছিলো কষ্টের কান্না, এখনের কান্না গর্বের। দ্বিতীয় সংসারে প্রাক্তন স্বামীর তিন ছেলে হয়েছে কিন্তু মানুষ হয়নি। বিপথে গিয়েছে। বাপের সম্পত্তি বিক্রি করে উড়িয়েছে। প্রাক্তন স্বামীর ভাইয়ের ছেলেরাও খুব বেশি উন্নতি করতে পারেনি।

ভিডিওটি দেখুন :  দিনের পর দিন আমাদের দেখা নেই, সাক্ষাৎ নেই , কথা নেই। কিন্তু কেন ?

প্ৰাক্তন শ্বশুরবাড়ির বংশধর ছেলেরা যে সম্পত্তি ধীরে ধীরে বিক্রি করছে, আমার তিন মেয়ে সেইসব তাদের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে। এইজন্য মেয়েরা ব্যাংক থেকে লোনও নিয়েছে। 

মায়ের অপমানের জবাব, মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের জবাব মেয়েরা এভাবে দিবে আমি কখনো কল্পনাও করি নাই। সত্যিই আল্লাহ মহান! যা কেড়ে নেন তার কয়েকগুন বাড়িয়ে দেন। সেদিনের সেই কষ্টের কারণে আজ আমি এতো বড় অর্জনের গর্বিত অংশীদার হয়েছি। 
 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment