ছোটগল্প : ইচ্ছে পূরণের দৈত্য
- ফারজানা আক্তার
- আগস্ট ৮, ২০২১
' আমার অল্প আয়ে সংসার শুরু করতে ভয় পাচ্ছ ? '
' আয় অল্প, নাকি বেশি সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না। কিন্তু বেকার হয়ে বিয়ে করার সাহস পাচ্ছি না। '
' আজকে আমি বেকার হলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে না ?'
' কি সব বলছো! তুমি আর আমি এক হলাম ? '
' আমরা কি তবে আলাদা ?'
' লিরা! তুমি একজন মেয়ে আর আমি একজন ছেলে। '
' তো? এমন তো নয় তুমি চাকরি পাবে না বা করবে না। তুমি চাকরি খোঁজছো। আজ না হলে কাল পেয়ে যাবে। আপাতত আমরা বিয়েটা করে নেই। '
ভিডিওটি দেখুন : সকালের নাস্তায় ওটমিল কেন খাবেন ?
পুরো দুই ঘন্টা তর্ক বিতর্ক করার পর লিরা তার লজিকে জিতে যায়। আমি গেলাম হেরে। বেশ লজিক জানা মেয়ে। কোন বিষয়ে লজিক ছাড়া নিজে কথা বলেও না, শুনতেও চায় না। যুক্তিবাদী বউ আমার। বেশ ভালো উকিল হতে পারতো কিন্তু ভুলক্রমে শিক্ষক হয়ে গেছে। বিয়ের সময় অতিথি শিক্ষক হিসেবে একটি বেসরকারি ভার্সিটিতে কর্মরত ছিলো। পরে অবশ্য পার্মানেন্ট শিক্ষক হয়েছে।
আমি অমিত। বর্তমানে ব্যবসায়ী। কোথাও চাকরি করতে পারিনি। সেই ধরাবাঁধা নিয়মে নিজেকে আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। ধরাবাঁধার নিয়মের বাহিরে কিছু করার ইচ্ছে সবসময় ছিলো। কিন্তু সময়, সুযোগ আর টাকা কোনটাই ধরা দিচ্ছিলো না। লিরা জীবনে আসার পরপর সকলকিছুই কিভাবে যেন ধরা দিলো আমার কাছে।
লিরার সাথে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে ঠিক হয়। তখন আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলাম। বিয়ের ঠিক হওয়ার তিনদিন পর আমার বাবা হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিয়ের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়। তারপর বাবার পাশে থাকার জন্য আমি চাকরি ছেড়ে দেই। বাবা অসুস্থ হওয়ায় চাকরি কেন ছেড়ে দিতে হবে এই অপরাধের কারণে লিরার পরিবার শুরু করলো অশান্তি। রীতিমতো লিরার বড় ভাই বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার হুমকি পর্যন্ত দিলো।
ভিডিওটি দেখুন : গর্ভবতী মহিলারা ক্ষতিকর এই রোগগুলো থেকে সাবধান থাকুন!
আমি বুঝতে পারলাম না বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে বা যদি বিয়েটা হয়েও যেতো তবুও তো তারা আমার চাকরিজীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। আমার পরিবারের জন্য কখন কোনটা ভালো হবে সেটা আমার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না। বিয়ে আমি করবো, দ্বায় - দায়িত্ব আমার, চিন্তা - ভাবনা আমার। কিন্তু পাত্রীপক্ষ দেখি আমার থেকে আমার চাকরি নিয়ে বেশি চিন্তিত। চিন্তিত না শুধু পাত্রী। সে দেখি উল্টো আমার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে। আমার সাহসের প্রশংসা করেছে।
আমি দোটানায় পড়লাম। পাত্রীর পরিবার বিয়ে ভেঙে দেয় দেয় অবস্থা, অন্যদিকে পাত্রী বিন্দাস আমার সাথে কথা বলছে, বাবার খোঁজ - খবর নিচ্ছে। চাকরি বিষয়ক সে কোন কথা বলছে না । হুট করে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত আমার পরিবারও ভালোমতো নেয়নি। বিশেষ করে বড় দুই ভাবী আমাকে কিছু বলতে পারছে না , মাকে যখন তখন কথা শুনাচ্ছে। সামনে বিয়ে। অনেক খরচের ব্যাপার। তাছাড়া বাবা অসুস্থ। এখানেও টাকা দরকার। আমি নাকি অলস! বাবার পাশে থাকার অজুহাতে চাকরি ছেড়েছি। কিন্তু আমার আসল মতলব ভাইদের ঘাড়ে বসে নিজে খাওয়া এবং বউকে খাওয়ানো!
ভিডিওটি দেখুন : শিশুর পেটে কৃমি? জানুন এর প্রতিকার...
আমার মা ভাবীদের কথা শুনে এসে আমাকে কথা শোনায়। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। দুই ভাইয়ের ভালো চাকরির সুবাদে সংসার মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তে টান নিচ্ছিলো। কিন্তু দুই ভাবীর ' আমার বর বেশি টাকা দেয়! আমার বরের একার সংসার নাকি! ' মন্ত্রে সংসারের সুখ আটকে গেলো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই সংসারে এখন শুধু টাকা নিয়েই কথা এবং তর্ক হয়। আগে সংসারে টাকার টানাটানি ছিলো কিন্তু সুখ ছিলো। এখন টাকার টান নেই. সাথে সুখও নেই।
এইদিকে আমি ভাবছি লোহা দিয়ে লোহা কাটার মতো টাকা দিয়ে এই সংসারের টাকা টাকা টপিক্স চাপা দিতে হবে। চাকরি করে আমার পক্ষে এটা সম্ভব না। বিশেষ করে চাকরির ধরাবাঁধা নিয়ম আর মেপে মেপে টাকা আয় দিয়ে আমার ইচ্ছে পূরণ হবে না। অনেকদিন ধরে ব্যবসার দিতে ঝুঁকতে চাচ্ছি । কিন্তু ক্যাশ পাচ্ছি না। বাবার কাছে তেমন টাকা নেই। যা আছে চাইতে লজ্জা লাগে। বড় দুই ভাইয়ের কাছে চাওয়ার ইচ্ছে নেই। কারণ ভাবীদের ছোটলোকি ভাইদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে।
ভিডিওটি দেখুন : ডেলিভারি পরবর্তী ফোলা কমাতে কিছু টিপস...
এতকিছুর মধ্যে বাবা তার পরিচিত এক কলিগের মাধ্যমে লিরার খোঁজ পায়। লিরার পরিবার আমার পরিবার থেকে বেশ ভালো অবস্থানে আছে। তারা একটি ভালো পরিবার এবং ছেলে খোঁজছিলো। আমাকে ভালো ছেলে এবং আমার পরিবারকে ভালো পরিবার মনে হয়েছে। সেই কারণে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। যেই আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি অমনি খামখেয়ালিপনা ছেলে হয়ে গেলাম আর আমার পরিবার হয়ে গেলো দায়িত্বজ্ঞানহীন।
যে ভয় আমার পরিবার পাচ্ছিলো সেটাই হলো। লিরার পরিবার থেকে বিয়ে ভেঙ্গে দিলো। যেদিন দুপুরবেলা তার পরিবার বিয়ে ভেঙ্গে দিলো, সেদিন বিকেলবেলা লিরা আমার কাছে এসে বিয়ের কথা বললো। ও আমাকেই বিয়ে করবে এবং অবশ্যই বেকার অবস্থায় বিয়ে করবে। মেয়ে মানুষের ভালোবাসা মিশ্রিত জেদ এবং অভিমানের কাছে আমরা পুরুষেরা সবসময় পরাজিত। আমিও সেদিন পরাজিত হয়েছিলাম। কাজী অফিসে গিয়ে লিরা একজন বেকার ছেলেকে বিয়ে করে নিলো। বিয়ের আগে দুই পরিবারকে জানিয়েছিলাম। তাদের বলেছিলাম আমরা ধুমধাম করে বিয়ে করতে চাচ্ছি না। দুইপক্ষ উপস্থিত থাকবে আর কাজীকে ডেকে বিয়ে করতে চাচ্ছি।
লিরার পরিবার রাজি হয়নি। আমার পরিবারও রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে বন্ধুদের ডেকে কাজী অফিসে বিয়ে করে নিলাম। যে বিয়ে ধুমধাম করে হওয়ার কথা ছিলো, সেটা চুপিচুপি হয়ে গেলো। বিয়ের পর দুইজন দুইজনের বাসায় গেলাম। কিন্তু পরিবারের লোকজন আমাদের সাথে কথা বলে না। আমার বাবা আমাকে ডেকে কিছু টাকা হাতে দিয়ে বৌমাকে কিছু কিনে দিতে বললো। সাথে আরেকটা কথা বললো। বিয়ের পর বউকে নিজের কাছে রাখতে। বিয়ের পর মেয়েরা বাপের বাড়িতে স্বস্তিবোধ করে না। তাও আবার যদি হয় এমন পালিয়ে করা বিয়ে।
ভিডিওটি দেখুন : দারুন এই কাজগুলো আপনার রান্না ঘরের কাজ সহজ করে দেবে!
বাপের রুম থেকে বের হয়ে লিরাকে ফোন দিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম লিরা কাঁদছে। নিজে কিছু বলছিলাম না। কাঁদতে কাঁদতে লিরা বললো এক রুমের একটা বাসা দেখতে। আপাতত সাবলেট হলেও চলবে। শুরু হলো আমার আর লিরার এক রুমের সংসার। আমার বাবার বাসার কাছেই বাসা নিলাম। বাবাকে দেখতে যেন আমার সুবিধা হয়। লিরা তার শিক্ষকতা, পাশাপাশি টিউশনি করাতে শুরু করলো। বাবার দেওয়া টাকাটা আমি লিরার হাতে দিয়েছিলাম। লিরা বলেছিলো আমার কাছে রাখতে। প্রয়োজনে সে নিবে।
ঘরের কাজ, রান্নাবান্না সব আমি নিজ দায়িত্বে করছি। সাথে বাবার দেখাশোনা। দুইটা রুম নিতে পারলে বাবা - মাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতাম। কিন্তু আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। লিরা অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে খুব শীগ্রই দুই রুমের বাসা নিয়ে বাবা - মাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসবে। লিরার মতো আত্মসম্মান মনে হয় আমারো নেই। বিয়ের পর আমাকে আর আমার পরিবারকে অসম্মান করায় সে তার বাবা মায়ের কাছ থেকে কিছুই নেয়নি। একদিনও সে বাসায় থাকেনি। তাদের বলে এসেছে যেদিন তাদের সমান সমান হতে পারবে সেদিন সেই বাসায় পা রাখবে। কিন্তু পরিবারের খোঁজ খবর নেয় সে।
লিরার আত্মসম্মান এবং ইগো দুইটাই বেশ প্রবল। ওর আত্মসম্মানকে সম্মান করি আর ইগোকে ভয় পাই। অতিরিক্ত ইগো সুস্থ সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। একটা ঘটনা ঘটার পর অনেক ধরণের কথাবার্তা হয়। সব ধরতে হয় না। আমার পরিবারও তো কম কথা শোনায়নি। কই তাদের আমি ছেড়ে দিয়েছি ? ভাবীরা কত বাঁকা বাঁকা কথা বলে তাই বলে তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি ? আমি ইগো আর আত্মসম্মানের ব্যালেন্স রেখে চলার চেষ্টা করি। লিরার মধ্যে এই ব্যাপারটা কম। কিন্তু মেয়েটা বেশ ভালো মনের, পরিশ্রমী এবং দায়িত্ববান।
ভিডিওটি দেখুন : হঠাৎ কোথাও আঘাত পেলে কী করবেন?
বিয়ের প্রায় ৫ মাস পর লিরা জানালো সে একটা ব্যাংক লোনের এপ্লাই করেছে। সেই টাকা আমার ব্যবসার জন্য। আমি কিসের ব্যবসা করবো এবং কিভাবে করবো সেই পরিকল্পনা যেন সাজিয়ে নেই। আমাকে বাজেটও বলে দিলো। বিয়ের এই পাঁচ মাসে আমি টুকিটাকি চাকরির চেষ্টা করিনি তা নয় কিন্তু মনের মতো হয়নি। আপাতত ব্যবসার কথা আমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিলাম । আগে তো চলার ব্যবস্থা করতে হবে, পরে অন্য চিন্তা। কিন্তু লিরা আমার ব্যবসার কথা ভুলেনি।
লিরার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছি এই মেয়েদের কে বলে অবলা ? কে বলে অসহায় ? লিরার জায়গায় আমি থাকলে এতদিনে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতাম। একটা ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সেই ছেলে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। তার পরিবার তাই বিয়ে ভেঙ্গে দিবে। এই অন্যায় সে মেনে নিতে পারেনি। কারণ চাকরি - বাকরি কারো দুই / চার / ছয় মাস নাই থাকতে পারে। তাছাড়া সে তো চাকরি করছে। চাকরি নেই একে ইস্যু করে বিয়ের মতো এতো বড় একটি ব্যাপার ভেঙ্গে দেওয়ার মতো অন্যায় সে করেনি।
পরিবারের অমতে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর স্বামী এবং শ্বশুড়বাড়ীর লোকদের অপমান করায় চুপচাপ বাবার বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে।চাকরির পাশাপাশি টিউশনি করছে। সংসারের আর্থিক যোগান দিচ্ছে। আবার, সেই সাথে স্বামীর ব্যবসার টাকা জোগাড় করছে। নতুন অবস্থায় ব্যবসার লস করার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি। তবুও সে রিস্ক নিচ্ছে। পুরুষ মানুষ হয়ে আমি নিজেও এতো সাহস করার কথা ভাবতে পারছি না। আমি উঠে গিয়ে লিরাকে জড়িয়ে ধরলাম। কোন ভাগ্যের জোরে আমি লিরার খোঁজ পেয়েছিলাম! লিরা আমার উপর বিশ্বাস রেখে যে রিস্ক নিতে যাচ্ছে তার মান আমাকে রাখতে হবে।
ভিডিওটি দেখুন : ভিটামিন ডি যুক্ত খাবারের যতো উপকারিতা...
আগে আমার ব্যবসার চিন্তা - ভাবনা ছিলো অন্যরকম। কিন্তু এখন যে অবস্থা অনেক ভাবনা চিন্তা করে মাঠে নামতে হবে। আমি ভাবলাম স্ট্রিট ফুডের ব্যবসা করবো। অফিস লোকেশনগুলো সিলেক্ট করে তিনটা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় তিনটা ফুড ভ্যান নামাবো।
সকল হাইজিন মেইনটেইন করে পুষ্টিগুণ বজায় রেখে অল্প দামে ভালো মানের খাবারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। তিনটা ভ্যানে ছয়জন লোক রাখবো। তিনজন বাবুর্চি আর তিনজন সহকারী থাকবে। সহকারীরা বাবুর্চিদের সাহায্য করবে, আবার কাস্টমারও হ্যান্ডেল করবে। লিরার সাথে আমি এই বিষয়ে আলোচনা করলাম। ও আমার আইডিয়া পছন্দ করলো। বিশ্বস্ত লোক পাবো কিনা সেটা চিন্তার বিষয়। আমি ওকে আশ্বাস দিলাম আগে কাজ শুরু করি, পরেরটা পরে ভাববো। কাজ করতে না গেলে তো মানুষ চেনা যাবে না।
লোন পেলাম, লোক খুঁজে বের করলাম, লোকেশন ঠিক করলাম , ভ্যান নিলাম। বাবা - মায়ের দোয়া আর ভালোবাসা মানুষের বিশ্বাস নিয়ে আমি ব্যবসা শুরু করলাম। আসলে লক্ষ্য ঠিক থাকলে আর গুছিয়ে কাজ করতে পারলে সকল কাজেই সফলতা পাওয়া যায়। ব্যবসা শুরু করার পর লিরাও ঘরের কাজে অনেকটা সাহায্য করে। ঘরের কাজগুলো কেউ একজন সুযোগ পেলেই করে নিচ্ছি।
বাবাকে দেখে আমি তিনটা লোকেশনে যাতায়াত করছি। কোনোদিন বাবাকে নিয়ে আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, কোনদিন লিরা। কেটে গেলো আরো কয়েকমাস। দুই রুমের বাসা নিয়েছি। আরো দুইটা নতুন ভ্যান কিনেছি। বাবা - মাকে নিজেদের কাছে নিয়ে এসেছি। লিরাও তার বাবার বাড়ি আজকাল যায় কিন্তু থাকে না। আমিও যাই, থাকতে চাই এক দুই রাত কিন্তু লিরার অমতে না। যাওয়া যেহেতু শুরু করেছে, খুব শীগ্রই থাকবেও। এই বিশ্বাস আছে আমার।সংগ্রামের দিন বুঝি ফুরালো, সফলতার দিন আসলো। আজকে ধানমন্ডিতে আমাদের প্রথম ফাইভ স্টার হোটেল এ্যান্ড রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন করা হবে। আমরা সকলে লিরার জন্য অপেক্ষা করছি। ও বাবাকে নিয়ে রেগুলার চেকআপে গিয়েছি।
ভিডিওটি দেখুন : কিউই ফলের নানান উপকারিতা...
বাবা এখন অনেকটা সুস্থ। আজ বাবার চেকআপ ছিলো আমাদের কারো মাথায় ছিলো না। লিরার ছিলো এবং সে আগে জানায়নি। গতকাল রাতে জানিয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আগে কেন জানায়নি তাহলে তারিখ চেঞ্জ করতাম। লিরা বললো প্রোগাম সন্ধ্যায়। আমরা দুপুরে যাবো চেকআপে। সমস্যা নেই। ডাক্তারের চেম্বার থেকে সোজা রেস্টুরেন্টে চলে যাবো। লিরাকে সমানে ফোন দিচ্ছি। রিং হচ্ছে কিন্তু ও ফোন তুলছে না। বাবার ফোন নেই। প্রথমদিকে স্বাভাবিক থাকলেও পরে আমার টেনশন বেড়ে গেলো। মা, আমার শ্বশুর - শ্বাশুড়ি তারাও চিন্তিত। ডাক্তারের নাম্বার আমার কাছে নেই যে তাকে ফোন দিবো।
বড় ভাইয়া ডাক্তারের চেম্বারের দিকে রওয়ানা দিলো। সেখান থেকে ভাইয়া ফোন করে জানালো তারা অনেক আগে বের হয়ে গেছে। আমার পুরো ঘাম ছুটে যাচ্ছে। বাবাকে নিয়ে লিরা কোথায় গেলো ?আমার মা আর শ্বাশুড়ি রীতিমতো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। আনন্দের একটা পরিবেশ রীতিমতো থমথমে হয়ে গেলো। মা আর শ্বাশুড়ীকে কী থামাবো! আমার নিজেরই ভিতর থেকে চিৎকার করে কান্না আসছে। কিন্তু কাঁদতে পারছি না। থানায় জানাবো কিনা ভাবছি। বড় ভাইয়াকে বললাম হাসপাতাল রোডে কোন একসিডেন্ট হয়েছে কিনা খোঁজ নিতে।
ভাইয়া জানালো হয়নি। লিরা উবারে গিয়েছে ডাক্তারের কাছে। উবারের গাড়ির নাম্বার বা ড্রাইভারের নাম্বার কিছুই আমি জানি না। মেজো ভাইয়া বললো আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর থানায় যেতে। সবকিছুতে একটু সময় দেওয়ার প্রয়োজন।
ভিডিওটি দেখুন : মুখের যাবতীয় সমস্যার সমাধানে ছয়টি মোক্ষম বিউটি টিপস...
আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। হাউমাউ করে কান্না করে দিলাম। লিরার কিছু হয়েছে এটা আমি ভাবতে পারছি না। কিন্তু এই মুহূর্তে পজেটিভ কোন ভাবনাও মাথায় আসছে না। সবাই যখন আমাকে নিয়ে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়ে রেস্টুরেন্টের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। বাবাকে উবারে বসিয়ে রেখে লিরা এসেছে ৫০ টাকার ভাংতির জন্য।
উবার ভাড়া ২০৫০ টাকা এসেছে। তার কাছে ৫০ টাকা ভাংতি নেই। লিরাকে দেখে আমি উঠে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলাম। কয়েকশো লোকজন চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে, বাবা - মা, শ্বশুর - শ্বাশুড়ি, ভাইয়া - ভাবী, লিরার ভাই - ভাবী এবং আত্মীয় - স্বজন কারো কথা মাথায় নেই। আমার মাথায় আছে আমার বউ ফিরে এসেছে এবং সুস্থ আছে।
লিরা পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বললো আগে টাকাটা দাও। উবার বিদায় করে আসি। না হলে আরো বিল বাড়বে। মেজো ভাইয়া উবারের বিল মিটিয়ে বাবাকে নিয়ে আসলো। সবাই মিলে ওদের ঘিরে ধরলাম কোথায় গিয়েছিলো এবং ফোন ধরেনি কেন এই বিষয়ে জানতে। তাদের ভাষ্যমতে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে লিরা বাবাকে অফার দেয় আমাদের ফুড ভ্যানগাড়িগুলো কোথায় কোথায় আছে দেখতে যাবে কিনা! যেহেতু হাতে সময় ছিলো আর বাবারও ইচ্ছে ছিল তাই বাবা রাজি হয়ে যায়। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকার সময় লিরা ফোন সাইলেন্ট করে ঢুকে। পরে আর ওর মনে ছিলো না।
আর, সব কয়টা জায়গায় জ্যাম ঠেলে যেতে যেতে তাদের দেরি হয়ে গেছে। বাবাও অনেকদিন পর ঘুরতে পেরে অনেক আনন্দ করছিলো। তাই প্রোগামের কথা মনে করিয়ে বাবার আনন্দে ভাটা ফেলতে চায়নি। ফোনে আমাকে জানাবে সেই কথাও মাথায় আসেনি। লিরার কথা শুনে রাগ করার বদলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো। বাবাকে নিয়ে কতবার ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করিনি বাবা কোথাও বসবে ? কিছু খাবে ? কোথাও যাবে ? মাকেও বলিনি। বিয়ের পর থেকে শুধু সংগ্রাম করে গিয়েছি। বউকেও বলিনি।
ভিডিওটি দেখুন : স্কিজোটাইপাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের লক্ষণগুলো কী ?
টাকার পিছনে এমনভাবে ছুটছিলাম আসলে সুখ, আনন্দের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ফাইভ স্টার হোটেল উদ্বোধন করার জন্য অপেক্ষা করছি। ঐদিকে আমার বউ আর বাপ উবার নিয়ে ফুড ভ্যান দেখতে বের হয়ে আনন্দ করছে। খুব অল্পতে ওরা খুশী আর আনন্দ খুঁজে নিয়েছে। আমি ওদের বিলাসবহুল জীবন দেওয়ায় ব্যস্ত, কিন্তু ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে কোয়ালিটি সময়, আন্তরিকতা। টাকা দিয়ে বিলাসিতা কেনা যায় কিন্তু মনের আনন্দ আর তৃপ্তি পাওয়া যায় না।
আমি লিরার হাত ধরে বললাম , ' চলো রাতে কক্সবাজার যাই । '
পাশ থেকে বাবা বললো, ' না। বউমা আগে পাহাড়ে যাবে। আসতে আসতে আমাকে বললো বউমার পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। '
আমি চোখ মুছতে মুছতে বললাম লিরা আমাদের ইচ্ছে পূরণের দৈত্য। এই দৈত্য এতদিন আমাদের ইচ্ছে পূরণ করেছে। এখন থেকে আমরা এই দৈত্যের ইচ্ছে পূরণ করবো।
লিরা সবার অলক্ষ্যে আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, ' তুমি মেয়েদের মতো এতো কান্নাকাটি করো কেন ? কিছু হলেই কান্না করো। এতো আবেগ কেন তোমার ?'
আমি ওকে বললাম সম্পর্কে একজনের দায়িত্বজ্ঞান বেশি থাকবে, অন্যজনের আবেগ। এই দুইটার ব্যালেন্স না হলে সম্পর্ক সম্পূর্ণ হয় না। তোমার দায়িত্বজ্ঞান বেশি, অন্যদিকে আমার আবেগ।
লিরা একহাতে আমার গাল টানতে টানতে বললো, ' ওরে আমার লাভগুরু!'
আমি লিরার দিকে তাকিয়ে ওর হাসি দেখছি। লিরার চোখেমুখে তৃপ্তির হাসি আর আমার প্রশান্তির।
ভিডিওটি দেখুন : স্কিজয়েড ব্যক্তিত্বের ব্যাধির লক্ষণগুলো কী ?