ছোটগল্প : সম্পর্কের খুঁটিনাটি

  • ফারজানা আক্তার
  • আগস্ট ৮, ২০২১

' আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না!? '

' ব্যস্ত আছি। পরে দিচ্ছি। '

' হ্যাঁ অথবা না উত্তর দিতে কয় দিন সময় লাগবে ? '

আমি ব্যাগ গোছাচ্ছি। এইদিকে অফিসের বেশ কিছু কাজও আছে। সেগুলোও শেষ করতে হবে। কাল এবং পরশু দুইদিন ছুটি নিয়েছি। অফিস কিছুতেই ছুটি দিবে না। অনেক যুদ্ধ করে ছুটি পেয়েছি। ছুটি আমি নিজের জন্য নেইনি। নিয়েছি এই মেয়েটার জন্য। যে মেয়েটা দুইদিন ধরে অপেক্ষা করছে  ' হ্যাঁ ' অথবা ' না ' এই দুইটির যে কোন একটি  উত্তর শোনার জন্য। 

মনে মনে আমি ভাবছি যে মেয়েটা দুইদিন ধরে শুধুমাত্র একটি প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে সে যদি ' না ' শোনে কী অবস্থা হবে! কিন্তু আমার তো উপায় নেই। তাই এই সেই বলে এভোয়েড করছিলাম। অবশেষে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু সেটা এখন দিবো, নাকি রাতে দিবো ভাবছি!আমি সরল। নাম সরল হলেও মানুষটা বেশ কঠিন। অবশ্য আগে কঠিন ছিলাম না। নামের মতোই সরল ছিলাম। কিন্তু পরিবেশ, পরিস্থিতি আর কিছু মানুষ আমাকে কঠিন বানিয়ে দিয়েছে। 

ভিডিওটি দেখুন :  জেনে নিন ঘরের কাজের টুকিটাকি কিন্ত প্রয়োজনীয় কিছু টিপস ...

এখন আমি চাইলেও সরল থাকতে পারি না। মন অনেক কিছু চাইলেও বাস্তবতার কথা চিন্তা করে পিছিয়ে যাই। জীবনে যে কষ্ট পরপর দুইবার পেয়েছি, সেই একই কষ্ট তৃতীয়বার পেতে চাই না। লিপির সাথে আমার পরিচয় একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে। আমার ছিলো কলিগের বিয়ে, ওর কাজিনের। আমার কলিগ ওর কাজিন হয়। অফিসের সকলে সেই বিয়েতে গিয়েছিলাম। লিপিরা সমবয়সী অনেক কাজিন, বন্ধুরা ছিলো। বিয়েতে সচরাচর যা হয়! এক বিয়ে বাড়িতে বিয়ে হয় একটি আর প্রেম হয় ১০০টি। ফ্লাটিং হয় কয়েকশো। 

এসব ফ্লাটিং, প্রেম থেকে অনেক আগেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। সবার সাথে হাই, হ্যালো বলে নিজের মতো ফোনে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে দিয়েছি।  বিয়ে বাড়িতে বেশ ছবি তোলা হয়। তখনই কিছু ছবি তুলে কলিগদের ট্যাগ দিয়ে আপলোড দিলাম। সেদিন রাতেই লিপির ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পেলাম। রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করার তিনদিন পর লিপি আমাকে মেসেজ দিয়েছে। এই ফর্মাল হাই, হ্যালো, কেমন আছি এসবই! আমিও ফর্মাল উত্তর দিয়েছি। এসবই চললো কয়েকদিন। 

' আপনি কথা কম বলেন ? নাকি আমার সাথে কমফোর্ট ফিল করছেন না ? ' লিপির প্রশ্ন। 

' কথা কম বলি। ' উত্তর দিলাম। 

' দুঃখিত! আমি মনে হয় আপনাকে ডিস্টার্ব করছি! '

' আপনি মনে হয় ডিস্টার্ব করছেন! কিন্তু আমি ডিস্টার্ব ফিল করছি না। বরং ভালো লাগছে। কেউ একজন সকাল সন্ধ্যা খোঁজ খবর নিচ্ছে। '

ভিডিওটি দেখুন : অপূর্ণতার ডায়রি ১

এভাবে আমাদের কথা এগিয়ে গেলো। নিজেদের অজান্তে ডিপেন্ডেন্সি চলে আসলো। অনুভূতি তৈরী হলো, ভালো লাগার জন্ম হলো, অধিকারবোধ আসতে গিয়েও থমকে গেলো! দায়িত্ববোধের দরজায় তালা দিলাম। নিজেকে বুঝলাম না! আমি কোন প্রেমের সম্পর্কে জড়াবো না। কোন কমিটমেন্টে যাবো না। ঘড়ির কাঁটা ধরে ধরে কমিটমেন্ট রক্ষা করা, অকেশন ধরে ধরে দায়িত্ব পালন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া একটি সম্পর্কে চাওয়া - পাওয়া যত কম থাকে সেই সম্পর্ক তত সুন্দর হয়। 

চাওয়া - পাওয়ার ভারে সম্পর্ক আর সম্পর্ক থাকে না, তখন সেটা প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি হয়ে যায়। সারাক্ষণ দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকতে হয়। আমার অবস্থান ক্লিয়ার করার জন্য লিপিকে একদিন দেখা করতে বললাম। অফিস শেষ করে দুইজন একটি কফি শপে মুখোমুখি বসে আছি। আজকে লিপির সাথে আমার দ্বিতীয় দেখা। প্রথম দেখা হয়েছে সেই বিয়ে বাড়িতে। বিয়ে বাড়িতে ওর কড়া মেকআপে ছিলো। আজকে সিম্পলভাবে দেখা করতে এসেছে। বেশ মিষ্টি লাগছে। তাছাড়া সেও সারাদিন অফিস করে জ্যাম ঠেলে এসেছে। মুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও চোখে বেশ উচ্ছলতা অনুভব করছি।  

বুঝতে পারছি না আমার অবস্থান ক্লিয়ার করার পর তার চোখের সেই উচ্ছলতা আদৌ থাকবে কিনা! কিন্তু না বলেও উপায় নেই। কারণ অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর লিপি ফিরতে পারবে কিনা বা আমি ফিরিয়ে দিতে পারবো কিনা অথবা স্বার্থহীন এই সম্পর্কের সৌন্দর্য বজায় থাকবে কিনা এসব ভাবনা আমাকে এলোমেলো করে দিচ্ছিলো।  স্বার্থের দুনিয়ায় আমার আর লিপির এই স্বার্থহীন সম্পর্কটা আজীবন এমন সৌন্দর্য নিয়ে বেঁচে থাকুক এটাই আমার চাওয়া। 

ভিডিওটি দেখুন :  প্রতিদিন সকালে লেবু পানি পানে আপনি কি কি উপকারিতা পাবেন ?

' হুট করে আজকে দেখা করতে বললেন যে! '

' তেমন কোন কারণ নেই। এমনি মনে হলো দেখা করি। গল্প করি। দুই একটা বিষয় ক্লিয়ার করি বা হয়ে নেই। '

' আমার কিছু বিষয় আপনার জানা উচিত। '

' জ্বি বলুন!'

' আপনি ডেকেছেন। আপনি বলুন। তারপর আমি বলবো। '

' আপনি শুরু করেন। লেডিস ফার্স্ট। '

' ভালোবেসে আমি ভীষণভাবে প্রতারিত হয়েছি। এই প্রতারণা আমার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। সেই ক্ষতের যন্ত্রণা এতটাই তীব্র আমি এখন কাউকে ভালোবাসতে পারি না, বিশ্বাস করতে পারি না এবং সেইসাথে খুব সহজে মানুষকে রিড করে ফেলি। 

দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ সুযোগসন্ধানী। তবে আমাদের সমাজের মানুষ তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই সুযোগসন্ধানী। যখন মানুষকে রিড করি তখন তাদের সেই সুযোগসন্ধানী রুপ আমার চোখে আগে ধরা পড়ে। ধীরে ধীরে মানুষের প্রতি নরমাল আগ্রহও হারিয়ে ফেলছিলাম প্রায়!

ভিডিওটি দেখুন : মুখের যাবতীয় সমস্যার সমাধানে ছয়টি মোক্ষম বিউটি টিপস...

বিয়ে বাড়িতে আপনার অ্যাটিটিউড্ কিছুটা আলাদা লেগেছে। সেই কারণে নিজ আগ্রহে আপনাকে রিকুয়েস্ট দিয়েছি এবং নিজ থেকেই কথা বলা শুরু করেছি। 

এই যে বেশ কিছু মাস আমরা কথা বললাম, শেয়ারিং / কেয়ারিং করলাম তাতে আপনার প্রতি আমার সম্মান আরো বেড়েছে। ভালো লাগা এবং আগ্রহ দুইটাই বেড়েছে। আপনাকে আমার নিরাপদ মনে হয়। বিশ্বস্ত মানুষ মনে হয়। 
কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে যদি অতীতের পুনরাবৃত্তি আবার হয়?  যদি আবার বেশি কাছে আসতে গিয়ে একেবারে হারিয়ে ফেলি ? বেশি শক্ত করে হাত ধরতে গেলে সেই হাতটাই আর থাকে না। বেশি ভালোবাসতে গেলে মানুষটাই থাকে না। অতীতের পুনরাবৃত্তি আমি জীবনে আর চাই না। স্বার্থহীন সুন্দর এবং স্বচ্ছ একটি সম্পর্ক চাই। '

ভিডিওটি দেখুন :  ঘরোয়া উপাদান দিয়ে দূর করুন কনুইয়ের কালো দাগ...

লিপির কথা শুনে সেদিন আমি পরপর দুই গ্লাস পানি খেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম লিপি আমার প্রেমে পড়েছে তাই নিজের অবস্থান ক্লিয়ার করতে এসেছি। লিপি ভেবেছে আমি তার প্রেমে পড়েছি তাই সে নিজের অবস্থান ক্লিয়ার করলো।  প্রেমে তো আমরা দুইজনই পড়েছি তবে যে প্রেমে  শারীরিক এবং মানসিক দুই ধরণের চাহিদা বিদ্যমান সেই প্রেমে আমরা পড়েনি। শুধুমাত্র মানসিকভাবে প্রেমে পড়েছি। 

সেদিন আমি নিজে আর কিছু বলিনি। সেখানেই কথাবার্তা শেষ করে যে যার বাসায় চলে গিয়েছি। এভাবেই চলছিলো আমাদের সম্পর্ক। আগামীকাল আমার জন্মদিন। লিপি প্রায় ১৫ দিন ধরে বলে যাচ্ছিলো আগামীকাল ছুটি নিতে। আমি দেখি! দিবে না! হবে না! সম্ভব না! এসব বলে যাচ্ছিলাম। 

ওর মনে খুব অভিমান জমেছে বুঝতে পারছি। গত দুইদিন আগে ছুটি সংক্রান্ত লাস্ট প্রশ্ন ছিলো। ছুটি আমি নিবো, নাকি নিবো না এটা যেন 'হ্যাঁ' অথবা 'না' - তে উত্তর দিয়ে দেই। 

এই মুহূর্তে ছুটি নেওয়া আসলেই সম্ভব ছিলো না। অনেক কষ্টে দুইদিনের ছুটি ম্যানেজ করেছি। কিন্তু ওকে জানাইনি। কারণ সারপ্রাইজ! লিপি আমার কলিগ মানে ওর কাজিনের সাথে প্ল্যান করেছে জন্মদিনে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে। আমি ওর কাজিন মানে আমার কলিগের সাথে প্ল্যান করেছি ওকে সারপ্রাইজ দিবো। কথায় কথায় লিপি তার শখ, স্বপ্ন, ইচ্ছে আরো নানানকিছু শেয়ার করেছে। 

ওর খুব ইচ্ছে হুটহাট প্ল্যানে ঢাকার বাহিরে ট্যুর দেওয়ার। আজ রাত ৯ টার ট্রেনে আমরা চট্টগ্রাম যাচ্ছি। আমরা বলতে আমি আর লিপি। আজকের রাতের ট্রেনে যাবো। কাল সারাদিন ঘুরে রাতের ট্রেনে আবার ব্যাক করবো। কলিগকে দায়িত্ব দিয়েছি যেভাবেই হোক লিপিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে নিয়ে আসতে। 

ভিডিওটি দেখুন :  নির্ঘুম রাতে, ঘুম আনুন ডেকে...

এই সারপ্রাইজ পেয়ে ওর চেহারাটা কেমন হবে ভাবতে ভালো লাগছে, আবার হাসিও পাচ্ছে। সারপ্রাইজটা আরেকটু গাঢ় করতে আজকে সারাদিন খুব ব্যস্ততা দেখাতে হবে। ওর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় আমার হবেই না। হাহাহা! ইচ্ছে করে এভোয়েড করবো আজকে সারাদিন। ওর মনে অনেক অভিমান জমবে কিন্তু প্রকাশ করতে পারবে না। কারণ অভিমান প্রকাশ করতে যে অধিকারটুকু লাগে সেটা আমাদের সম্পর্কে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে, কিন্তু প্রকাশ করার সাহস কেউ দেখাবে না। 

এই সম্পর্কে অনুভূতির লাগাম আছে, অধিকার প্রকাশের ব্যারিকেড আছে, কিন্তু কারো প্রতি কারো স্নেহ - মায়া এবং তার চাওয়া - পাওয়ার প্রতি সম্মানের কমতি নেই।  শুধুমাত্র এই কারণে আমাদের সম্পর্কটা আজীবন সুন্দর এবং স্বচ্ছ থাকবে। 

 

এ সম্পর্কিত আরও পোস্ট

Leave a Comment