পেঁপে: দি সুপার ফ্রুট  ,আসন্ন গরমের দাওয়াই!

  • ডাঃ রীপা চক্রবর্তী 
  • ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮

মালিক সাহেব বহুদিন কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছেন। ডক্টর দেখিয়েছেন,বহুলাংশে অসুধ নিয়েছেন। রুটিন মেনে চলার পরও পুরোপুরি ঠিক হন নি। ইসবগুলে কিছুটা উপকার পেলেও তা স্থায়ী হয়নি। তোকমা ভিজানো পানি খেলেও আজকাল আর কাজ হয়না। 

রাহিমা বেগমের শারীরিক শক্তি দিন দিন যেন ফুরিয়ে আসছে।খুব রুটিন মেনে চলার পরও দূর্বলবোধ করেন, সামান্য কাজে হাঁপিয়ে যান।  তারা দুজনেই বাধ্য হয়ে এবার একজন খাদ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হলেন। তিনি তাদের প্রচুর পরিমানে পাঁকা পেঁপে আর কাঁচা পেঁপের সালাদ ও সুপ খেতে দিলেন। এক মাসের মধ্যে তারা অভূতপূর্ব ফলাফল পেলেন। মালিক সাহেব ও রাহিমা বেগমের মত অনেক রোগীই এভাবে পেঁপে ডায়েটে যোগ করে সুস্থ আছেন।

এরকম সমস্যা মূলত যে কারণে হয় :

১. ব্যস্ত জীবনযাত্রা,

২. প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবার ও পানীয় গ্রহণ,

৩. নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম না করা,

৪. প্রস্রাব ও মলত্যাগ সময়মত না করা বা দীর্ঘ সময় আটকে রাখা,

৫. আঁশযুক্ত খাবার না খাওয়া,

৬. সময়মত খাবার গ্রহণ না করা,

৭. দীর্ঘদিন ভাঁজাপোড়া খাদ্য গ্রহণ ও বিভিন্ন গ্যাস্ট্রিকজনিত রোগে ভোগা,

৮. মানসিক বৈকল্য বা বিষন্নতা ইত্যাদি হল কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রধান কারণসমূহ. 

এছাড়া আরো রয়েছে :

১. বড় ধরনের কিছু অপারেশনের পরে(যেমন: হার্টের বাইপাস সার্জারী,খাদ্যনালীতে অপারেশন )শরীর সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে কিছু সময় নেয়। তখন সঠিক নিয়ম মেনে না চলা হলে তা পরবর্তিতে দূর্বল্যে রুপ নেয়। 

২. পোস্ট-পার্টাম বা প্রেগনেন্সির পরবর্তিতে মা ও শিশু উভয়ের পুষ্টির চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ।  সঠিক মাত্রায় ও সঠিক অনুপাতে খাদ্য না গ্রহণ করা হলে পরবর্তিতে মা ও শিশু অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন অসুখে পড়ে যায়।  সেইসাথে মানসিক বিষাদ, অতিরিক্ত ওজন ও কোষ্ঠকাঠিন্যের মত সমস্যা তৈরী হয়। 

এখন আমরা জানবো পেঁপে আমাদের জন্যে কতটা উপকারী :

১. আমরা জানি,রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বেড়ে গেলে তা বিভিন্ন ধরণের হার্ট ডিজিজ যেমন : হাইপারটেনশন,হার্ট এটাকের কারণ হয়ে ওঠে। 
পেঁপেঁ প্রচুর পরিমানে ফাইবার, এন্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ যা হার্টের ধমনীর গায়ে কোলেস্টেরলের জমে ওঠা প্রতিহত করে। 

২. যারা ডায়েট কন্ট্রোল করছেন অথবা ওজন কমাতে চান,তারা নিশ্চিন্তে পেঁপে খান কারণ পেঁপেতে ক্যালোরি মাত্রা খুবই কম (৪৩ ক্যালোরি প্রতি ১০০ গ্রাম-এ। এটি তাই পেট ভরাতে অথচ আপনাকে ফিট রাখতে এক্সপার্ট। 

৩. একটি মাঝারি পেঁপেতে আপনার দৈনিক চাহিদার ২০০% এর বেশি ভিটামিন সি থাকে,যা নিঃসন্দেহে আপনার ইমিউনিটি বাড়াতে সহায়ক ও বিভিন্ন অসুখ -বিসুখে সুরক্ষা প্রদান করে। 

৪. পেঁপে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যেও খুব ভালো কারণ এতে প্রাকৃতিক চিনির পরিমান খুবই কম। যারা চান ডায়াবেটিস থেকে দূরে থাকতে অথচ মিষ্টি-জাতীয় খাবারের প্রতি দুর্বল,তারা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পেঁপে খেতে পারেন নিয়মিত। 

৫. পেঁপে আপনার দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে কারণ এতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ আছে (৯৫০ ইউ প্রতি ১০০ গ্রামে),এটি সেই সাথে বয়সজনিত মাস্কুলার ডিজেনারেশন প্রতিহত করে।  

৬. যারা আর্থরাইটিস এর রোগী তাদের জন্যে পেঁপে একটি আদর্শ খাবার কারণ এর এন্টি-ইনফ্লামেটরি গুন্ ভিটামিন সি এর সাথে যৌথভাবে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখে আর এটি একটি সমীক্ষায় প্রমাণিতও হয়েছে। (আন্নালস অফ  রিউম্যাটিক ডিজিজ) 

৭. পেঁপেতে রয়েছে প্রচুর ডায়েটারি ফাইবার যা আপনাকে দায়ে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি কারণ এতে রয়েছে প্যাপেইন এনজাইম আর প্রচুর জলীয় অংশ যা আপনার হজমশক্তি বাড়ায় ও পাকযন্ত্রের উন্নতি সাধন করে। প্যাপেইন আপনার ডাইজেস্টিভ সিস্টেমকে রেগুলার করে,আপনার পাকযন্ত্রের এসিডিক পরিবেশেও একটিভ থাকে ও প্রোটিন ডাইজেশন-এ সহায়তা করে। নিয়মিত পেঁপে খেলে গ্যাস এর প্রব্লেম ,বুকজ্বালা করা, বদহজম ,ইর্রিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম এর মতো সমস্যা প্রতিহত করা যায়। এটি পাকস্থলীর গায়ে অনেকটা এন্টাসিড ওষুধের মতো আবরণ তৈরী করে,ফলে গ্যাস্ট্রিক আলসার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এছাড়া,কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্যাপেইন পাকযন্ত্রের ভালো ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা বাড়াতেও ভূমিকা রাখে,যা পাকস্থলীর পরিবেশ উন্নত করে আপনাকে প্রশান্তি দেয়। 

৮. এছাড়াও পেঁপে আপনাকে মানসিকভাবে শক্তি প্রদান করে,আপনার এজিং প্রতিহত করে ও মহিলাদের মেন্সট্রুয়াল সাইকেল জনিত ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে। 

৯. সর্বোপরি, পেঁপে ক্যান্সার এর ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে দেয় কারণ এতে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্টস,ফ্লাভনয়েড আর ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস যা ফ্রি রেডিকাল দ্বারা ড্যামেজ থেকে কোষকে রক্ষা করে। এটি সাইন্টিফিকাল্লি এখন প্রমাণিত যে পেঁপে কোলন ও প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিহত করে। 

তবে,এতো গুনের পরেও এর কিছু মন্দ দিক আছে :

গর্ভবতী মা-দের কাঁচা পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে ডাক্তারগণ পরামর্শ দেন কারণ পেঁপের ল্যাটেক্স,পেপসিন ও প্যাপেইন এনজাইম গর্ভাশয়ের কন্ট্রাকশন করে যা গর্ভপাত ঘটায় ,সময়ের পূর্বেই লেবার পেইন আনয়ন করে, গর্ভস্থ সন্তানের বিকাশ সাধনে বাধা দেয় এমনকি বিষক্রিয়া তৈরী করে যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্যে। এমনকি অনেকে গর্ভাবস্থার থার্ড ট্রাইমেস্টার-এ পাকা পেঁপে খাওয়া যে এমন বলেন,কিন্তু এটিও ঝুঁকি নেয়ার সমতুল্য। তাই পেঁপে মাতৃদুগ্ধ প্রদানকারী মা-দের জন্যই উপযুক্ত কারণ এর ক্যালসিয়াম,ভিটামিন,এন্টিঅক্সিডেন্টস শিশুর পরিশেষে,সবচেয়ে ভালো পরামর্শ হবে এটা যে, আপনারা শুধুমাত্র কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য কাঁচা পেঁপে সালাদ হিসেবে খেতে পারেন। অন্য সকল ক্ষেত্রে পাকা পেঁপে খাওয়াই যুক্তিযুক্ত ও ক্লিনিক্যালি প্রমাণিত।  তাছাড়াও ,সবসময় যেকোনো ফল ও সবজন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

জি ভালো করে ধুয়ে ও সঠিক প্রক্রিয়ায় রান্না করে খাবেন ,নিয়মিত ব্যায়াম করবেন ,নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখবেন,সবসময় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে জীবনযাপন করবেন,নিজেকে ভালোবাসবেন। তখন সুস্থতা সর্বদা আপনার কাছেই থাকবে।  


 

Leave a Comment