একসময়ের রাখাল বালক এখন দেশ সেরা অর্থনীতিবিদ
- ইয়াসিন প্রধান সাজিদ
- জুন ৮, ২০২১
রাখাল বালক, টাকা তুলে অন্যের বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়ে উঠেন ড. আতিউর রহমান। যার গল্পটি আসলেই সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। সবকিছু ছুটে গিয়েও জুড়ে গিয়েছিল তার গুন এবং ভাগ্যের জোরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। এই আতিউর রহমান ই রাখাল ছিলেন। খেয়ে না খেয়ে তার জীবন কাটতো। অন্যের দয়ায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
সেই রাখাল বালক এখন দেশ সেরা অর্থনীতিবিদ। তার চেষ্টা, গুণ এবং ধৈর্য্য তাকে এতটুকু আসতে সাহায্য করেছে। ড. আতিউর রহমান এর জন্ম জামালপুর জেলার এক অজপাড়াগাঁয়ে। ১৪ কিলোমিটার দূরের শহরে যেতে হতো হেঁটে বা সাইকেলে চড়ে। তাদের পুরো গ্রামের মধ্যে একমাত্র মেট্রিক পাস ছিলেন আতিউর রহমানের চাচা মফিজউদ্দিন। উনার বাবা একজন অতি দরিদ্র ভূমিহীন কৃষক। আতিউর রহমান এর পাঁচ ভাই, তিন বোন ছিল।
আরো পড়ুনঃ তরকারীতে ঝাল বেশী হলে কমাবার উপায় কি ?
কোনরকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটতো আবার তাদের ভালো কোনো পোশাক ছিল না। বাড়ি ছেড়ে একটু দূরে যেতেই তাদের বাধা চলে আসতো পোশাকের অভাব। উনার দাদার আর্থিক অবস্থা ছিলো মোটামুটি। দাদার বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটা ছনের ঘরে ভাই-বোন আর বাবা-মা নিয়ে থাকতেন আতিউর রহমান। মা তার বাবার বাড়ি থেকে নানার সম্পত্তির সামান্য অংশ পেয়েছিলেন।
সে টাকা দিয়ে তিন বিঘা জমি কেনা হয়েছিল। চাষাবাদের জন্য অনুপযুক্ত ওই জমিতে বহু কষ্টে যা ফলানো হত, তাতে বছরে ৫/৬ মাসের খাবার জুটতো। দারিদ্র যেন তার পরিবারকে গ্রাস করে ফেলেছিল সব দিক থেকে। এভাবেই তার ছোটবেলার দিন গুলো কাটছিল। মায়ের কাছ থেকে পড়াশোনার হাতেখড়ি পায় আতিউর রহমান। তারপর বাড়ির পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তার পরিবারে এতটাই অভাব যে, যখন তৃতীয় শ্রেণীতে উঠে, তখন আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলো না। বড় ভাই আরো আগে স্কুল ছেড়ে কাজে ঢুকেছেন। তাই একই ভাবে লেখাপড়া ছেড়ে রোজগারের পথে নামতে হয় তাকেও।
বাড়িতে একটা গাভী আর কয়েকটা খাসি ছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওগুলো মাঠে চড়াতে তিনি। বিকেল বেলা গাভীর দুধ নিয়ে বাজারে গিয়ে বিক্রি করতো। এভাবে দুই ভাই মিলে যা আয় করা হতো, তাতে কোনরকমে দিন কাটছিল। কিছুদিন চলার পর এই দুধ বিক্রির আয় থেকে সঞ্চিত আট টাকা দিয়ে পান-বিড়ির দোকান দিয়েছিল আতিউর রহমান। তারপর প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানে বসতো তিনি। পড়াশোনা তো বন্ধই, আদৌ করা হবে কিনা- সেই স্বপ্নও ছিল না তার। এক বিকেলে বড় ভাইয়ের সাথে স্কুলে যান নাটক দেখতে।
আরো পড়ুনঃ গরমে কেমন অলংকার পরবেন !
তখন গায়ে দেওয়ার মতো কোন জামাও ছিলনা তার। খালি গা আর লুঙ্গি পরে ভাইয়ের সঙ্গে নাটক দেখতে গিয়েছিল। স্কুলে পৌঁছে আনন্দময় চমৎকার পরিবেশ দেখে তার মনে হলো, আমিও তো আর সবার মতোই হতে পারতাম। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে আবার স্কুলে ফিরে আসতে হবে। আতিউর রহমান নাটক দেখে বাড়ি ফেরার পথে বড় ভাইকে বলেছিল, আমি কি আবার স্কুলে ফিরে আসতে পারি না ? তিনি বললেন, ঠিক আছে কাল হেডস্যারের সঙ্গে আলাপ করবো। পরের দিন স্কুলে গিয়ে কোনো ভাবে মিনতি করে বড় ভাই তার পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি নিয়ে দেয়।
তিনি পরীক্ষার তিন মাস আগেই মায়ের কাছে ছুটি চায় কারণ ঘরে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই-কোন বইও ছিল না, কিন্তু তাকে যে পরীক্ষায় পাস করতে হবে। বন্ধু মোজাম্মেলের বাড়িতে গিয়ে সবকিছু খুলে বলতেই বন্ধুর মা রাজি হোন। তার খাবার আর আশ্রয় জুটলো; শুরু হলো নতুন জীবন।
যথাসময়ে পরীক্ষা শুরু হলো। শেষ হবার পর ফল প্রকাশের দিন স্কুলে গিয়ে তিনি প্রথম সারিতে বসেন। হেডস্যার ফলাফল নিয়ে এলেন। তারপর ফল ঘোষণা করলেন। আতিউর প্রথম হয়েছেন !
আরো পড়ুনঃ ত্বকের বলিরেখা দূর করার প্রাকৃতিক উপায়
যেন এটাই হওয়ার কথা ছিল। আতিউর এর বাবা যখন শুনলেন আতিউর ওপরের ক্লাসে উঠেছে, নতুন বই লাগবে, পরদিনই ঘরের খাসিটা হাটে নিয়ে গিয়ে ১২ টাকায় বিক্রি করে দিলেন। তারপর আতিউরকে নবনূর লাইব্রেরি থেকে নতুন বই কিনে দিলেন। আতিউর তারপর রোজ আবার স্কুলে যেতে লাগলল। স্যারদের সুনজরে ছিল আতিউর। সবার আদর, যত্ন, স্নেহে ফার্স্ট হয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে তিনি। গ্রামের একমাত্র মেট্রিক পাস মফিজউদ্দিন চাচাও তাকে দেখে অনেক আদর করতেন।
তার বাড়িতেও আতিউর থাকতো। এই চাচা একদিন একটা বিজ্ঞাপন কেটে নিয়ে এসে আতিউরকে দেখালেন। ওইটা ছিল ক্যাডেট কলেজে ভর্তির বিজ্ঞাপন। যথাসময়ে ফরম পুরণ করেছিল আতিউর। দুই মাস পর চিঠি আসে আতিউর নির্বাচিত হয়েছে। এখন চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যেতে হবে। ওখানে যাওয়ার জন্য ও তার প্যান্ট অথবা ভালো জুতো ছিলনা। তখন জুটেছিল স্কুলের কেরানির ফুলপ্যান্ট। আর একটা শার্ট কোনোভাবে যোগাড় হলো।
তারপর এগুলো নিয়ে গিয়েছিল ঢাকা। পরীক্ষায় পিটি স্যার তাকে দেখে আর লিখিত পরীক্ষার খাতায় দেখে অনেকটা আচ করতে পেরেছিলেন।। আতিউর ও বুঝতে পারে যে, সে তাদের পছন্দে এসেছে। পরদিন ঢাকা থেকে চলে আসে আতিউর ভাবে সে চান্স পাচ্ছেনা। হঠাৎ তিন মাস পর সে চিঠি পায় চান্স পেয়েছে, বেতন ১৫০, এর মধ্যে ১০০ টাকা বৃত্তি দেওয়া হবে, বাকি ৫০ টাকা দিতে হবে।
আরো পড়ুনঃ যেসব ব্যায়ামে আপনার ওজন কমবে না !
চিঠি পড়ে মন ভেঙে যায় আতিউরের। এই টাকাটাই যোগান দেওয়া ছিল কষ্টস্বাধ্য। তখন হঠাৎ আতিউরের দাদা আসেন আর তাকে অন্য চাচাদের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোমরা থাকতে নাতি আমার এত ভালো সুযোগ পেয়েও পড়তে পারবে না ? কিন্তু তাদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো ছিল না। তারা বললেন, একবার না হয় ৫০ টাকা যোগাড় করে দেবো, কিন্তু প্রতি মাসে তো সম্ভব নয়। দাদাও বিষয়টা বুঝলেন।
আতিউরের শিক্ষক ফয়েজ মৌলভী স্যারের কাছে গেলে। তিনি বলেন, আমি থাকতে কোন চিন্তা করবে না। পরদিন আরো দুইজন সহকর্মী আর আতিউরকে নিয়ে তিনি হাটে গেলেন। সেখানে গামছা পেতে দোকানে দোকানে ঘুরলেন। সবাইকে বিস্তারিত বলে সাহায্য চাইলেন। সবাই সাধ্য মতো আট আনা, চার আনা, এক টাকা, দুই টাকা দিলেন। সব মিলিয়ে ১৫০ টাকা হলো। আর চাচারা দিয়েছিল ৫০ টাকা। এই সামান্য টাকা সম্বল করে আমি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয় আতিউর।
যাতায়াত খরচ বাদ দিয়ে আতিউর ১৫০ টাকায় তিন মাসের বেতন পরিশোধ করে। শুরু হয় তার অন্য এক জীবন। প্রথম দিনেই আতিউর এম. ডাব্লিউ. পিট স্যারকে সবকিছু খুলে বলে আর জানায় যে, যেহেতু তার আর বেতন দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তাই তিন মাস পর ক্যাডেট কলেজ ছেড়ে চলে যেতে হবে তাকে। টাকার জন্য আর বেতন দিতে পারবে না তাই তার পড়া আবার বন্ধ হয়ে যাবে। সবকিছু জানার পর স্যার বিষয়টা বোর্ড মিটিংয়ে তুললে পুরো ১৫০ টাকা বৃত্তিতে ব্যবস্থা হয়ে যায়।
সেই থেকে আতিউর নিশ্চিন্তে তার পড়াশুনা চালিয়ে যায় তারপর এস.এস.সি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে পঞ্চম স্থান অধিকার করে এবং আরো অনেক বড় বড় স্থানে সাফল্য অর্জন করে সে। আর আজ পর্যন্ত তার জীবনের এই সাফল্য টাও অর্জন করে।
আরো পড়ুনঃ মর্নিং সিকনেস কি? একে মর্নিং সিকনেস বলা হয় কেন?
তার এই সাফল্যর পর সে অনেক অনেক ভালো ভালো কাজ করেছে তার গ্রাম সহ অন্যান্য জায়গাতেও। কিন্তু স্কুলের জন্য হাট থেকে তোলা ১৫০ টাকার ঋণ হয়তো কখনোই শোধ করতে পারবে না। তাই অসহায়ত্বের সময় যেখানে দরকার তার স্বরণাপন্ন হওয়া দরকার আর সাফল্যর পর সবাইকে আবার নিজ সাধ্য মত সাহায্য করা দরকার।
তথ্যঃ গুগল