বাপকা বেটাদের পথযাত্রার প্রধান চাবিকাঠি ঋতুরাজের মা।
- ফারজানা আক্তার
- আগস্ট ১১, ২০২১
সারাজীবন আমরা শুনে এসেছি ছেলেরা হয় মায়ের ন্যাওটা, মেয়েরা বাবার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। এইরকম ভিন্নতা সকল ক্ষেত্রেই কমবেশি হয়। তেমনই এক ভিন্নতা নিয়ে অনলাইন দুনিয়া কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে Baap ka beta - বাপকা বেটা।
ফেসবুকে আছেন আর এই Baap ka beta - বাপকা বেটাদের চিনেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গুড প্যারেন্টিংয়ের উজ্জ্বল উদাহরণ শুভাশীষ ভৌমিক। আজকে বাবা শুভাশীষ ভৌমিক এবং ছেলে ঋতুরাজ সম্পর্কে অনেক অজানা কথা আমরা জানবো। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারজানা আক্তার।
ওমেন্সকর্নার : কেমন কাটলো করোনাকালীন এই কঠিন সময়টা ?
শুভাশীষ ভৌমিক : আসলে কঠিন সময়টা কিন্তু এখনও পার হয়ে যায়নি। কিন্তু এই কঠিন সময়ের মধ্যে যথাসাধ্য পজেটিভ থেকে কিভাবে কঠিন সময়টাকে মোকাবেলা করা যায় তার চেষ্টাই যথাসাধ্য করে আসছি। চেষ্টা করেছি নিজেদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত করে এই সময়টাকে কাজে লাগানোর।
ওমেন্সকর্নার : ঋতুরাজের সাথে শুভাশীষ ভৌমিকের বাবা - ছেলের সম্পর্ক বেশি, নাকি গুরু - শিষ্যের, নাকি বন্ধুত্বের ?
শুভাশীষ ভৌমিক : আসলে ওর সাথে আমার সম্পর্কটা এমন যেন, ও নির্দ্বিধায় আমার সাথে সব কিছু শেয়ার করতে পারে, একদম বন্ধুর মত। ছোটবেলা থেকে আমার সাথে আমার বাবার সম্পর্কও এমন। অসাধারণ মানুষ তিনি এবং আমি ওনাকেই অনুকরণ করি।
আমি সবসময়ই চেস্টা করি আমার সীমিত জ্ঞানের সব ভালো অভিজ্ঞতাগুলো যেন আমি ঋতুরাজকে শেয়ার করতে পারি এবং তখন হয়তো আমাদের সম্পর্কটা গুরু-শিষ্যের।
কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো আমরা বাবা ছেলে।
আরো পড়ুন : আপনার দুই সন্তানের মাঝে তিক্ততা, বুঝবেন যেভাবে
ওমেন্সকর্নার : ফেসবুকে আমরা দেখি ঋতুরাজ বাবার ন্যাওটা। ফেসবুকের বাহিরে ঋতুরাজ কার ন্যাওটা বেশি ?
শুভাশীষ ভৌমিক : আমাদের পরিবারের সবার সাথে সবার সম্পর্কই যথেষ্ট মজবুত। ঋতুরাজের সবকিছুর পেছনে ওর মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। ওর সবকিছুর দেখাশোনা, পড়াশোনা এমনকি বাপকা বেটার সকল কর্মকান্ড ওর মা ছাড়া অসম্ভব। তাই ঋতুরাজ মায়েরও ন্যাওটা।
কিন্তু আমার মায়ের প্রতি ও একটু বেশিই দুর্বল। কারণ ওর দাদি ওকে প্রতিরাতে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ায় এবং ওর সব অন্যায় আবদার তিনিই পূরণ করেন।
ওমেন্সকর্নার : এইটুকু বয়সে ছেলের এতো জনপ্রিয়তা। বাবা হিসেবে অবশ্যই গর্বিত আপনি। পাশাপাশি কোন ভয় কি কাজ করে ?
শুভাশীষ ভৌমিক : জনপ্রিয়তা শব্দটা আমি কখনোই ওকে বুঝতে দেইনি এবং ওর বোঝার বয়সও হয়নি। আসলে আমি মনে করি আমরা এখনো ততটা যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু মানুষের স্বার্থহীন ভালোবাসায় আমরা সত্যিই সিক্ত,যা আসলে আমাদের দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দিয়েছে।
একটাই ভয় কাজ করে তা হচ্ছে, কিভাবে মানুষের এই ভালবাসার মর্যাদাটুকু ধরে রাখবো, কিভাবে নিজেদেরকে আরো শাণিত করব? এই চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে।
আর গর্ব করবো সেদিন,যেদিন ও সত্যিকারে দেশের জন্য কোন বড় অর্জন বয়ে আনবে। সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী আমরা যেন এই উদ্দমতাটুকু ধরে রাখতে পারি।
আরো পড়ুন : বাচ্চারা মিথ্যা কথা বলা শুরু করলে যেভাবে বন্ধ করবেন
ওমেন্সকর্নার : আপনি নিজে কর্পোরেট জগৎতের মানুষ। শত ব্যস্ততার মধ্যেও ছেলেকে কোয়ালিটি সময় দিচ্ছেন। কিভাবে ম্যানেজ করছেন ?
শুভাশীষ ভৌমিক : ছোটবেলা থেকেই আমি সময়ানুবর্তিতা এবং নিয়মানুবর্তিতাকে সবসময় প্রাধান্য দিয়েছি। আমি সব সময় ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স নিতীতে বিশ্বাসী। কাজ জীবনে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কখনই তা আপনার আপনজনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি সবকিছুই নির্ভর করে আপনার ইচ্ছা শক্তির উপরে। আপনি চাইলেই আপনার সময়কে সুন্দরভাবে বন্টন করে নিতে পারেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজস্ব ক্যালান্ডার মেন্টেন করি, যেখানে আমি কখন কি করবো তার রিমাইন্ডার সেট করা থাকে।
ওমেন্সকর্নার : ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে যেসব বাবারা সন্তানদের সঠিক সময়টুকু দিচ্ছেন না। তাদের উদ্দেশ্য কিছু বলুন।
শুভাশীষ ভৌমিক : দেখুন, সবার জীবনধারা এক ধরনের হয় না। বাস্তব জীবনে একজনকে এক ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। তাই একই জীবনদর্শন সবার জন্য ঢালাওভাবে উপযোগী নাও হতে পারে। কিন্তু একটা কথা বলতে পারি তা হচ্ছে আপনার সন্তানের শৈশব বারবার ফিরে আসবেনা। তাই যদি সম্ভব হয় এই সময়টাকে উপভোগ করার চেষ্টা করুন,তাদের সময় দিন। এই স্মৃতিগুলো বৃদ্ধ বয়সে আপনার খোরাক হিসেবে কাজ করবে।
আরো পড়ুন : একজন বাবার গল্প...
ওমেন্সকর্নার : গান ছাড়া ঋতুরাজ আর কিভাবে সময় কাটাতে পছন্দ করে ?
শুভাশীষ ভৌমিক : গান ছাড়া ও এখন আমার সাথে বিকেলে ফুটবল খেলে, গিটার শেখে, গান শিখে। আমি, ওর মা এবং ও প্রতিদিন বিকেলে ৩০ মিনিট সাইকেল চালাই। প্রতি রাতে ওর সবচেয়ে প্রিয় কাজ হচ্ছে ওর দাদা-দাদী ও মা এর সাথে লুডু খেলা।
ওমেন্সকর্নার : আপনার নতুন উদ্যোগ ' মূল্যবোধের পাঠশালা ' নিয়ে কিছু বলুন।
শুভাশীষ ভৌমিক : আমাদের চারপাশে আমরা শুধু দেখতে পাই মূল্যবোধের অবক্ষয়। হিংসা, বিদ্বেষ,একে অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করা,গুনী মানুষদের অবজ্ঞা করা, কি না হচ্ছে আমাদের চারপাশে। আমার কাছে মনে হয়েছে এর সমাধান একটাই। ছোট থেকে বাচ্চাদের মূল্যবোধের চর্চা করা।
আমার মতে ৬ থেকে ১২ বছর বয়স হচ্ছে বাচ্চাদের মূল্যবোধ তৈরির শ্রেষ্ঠ সময়। আমরা যদি প্রত্যেকে তাদের নিজেদের বাচ্চাদের দায়িত্ব নেই, তাহলে হয়তো আগামী ২০ বছরের মধ্যে আমরা এক নতুন বাংলাদেশ দেখতে পাবো।যে বাংলাদেশে একে অন্যের সাফল্যের প্রশংসা করবে, সবাই সহনশীল ব্যবহার করবে, থাকবেনা কোন সাইবার বুলিং, যেখানে নারীরা তাদের প্রাপ্য সম্মান বুঝে পাবেন,যেখানে শুধু উন্নয়নের কথা হবে, থাকবে না কোন হিংসা, বিদ্বেষ,হানাহানি।
তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি যেন আমরা আমাদের সন্তানদেরকে মূল্যবোধের চর্চা করতে শেখাই, সেই চিন্তা থেকেই আমার "মূল্যবোধের পাঠশালা" এর শুরু।
আরো পড়ুন : সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে যেসব ভুল করে থাকে অভিভাবকেরা
ওমেন্সকর্নার : ছেলের সাথে কাটানো সবথেকে সুন্দর মুহূর্তের দুই একটা ঘটনা শেয়ার করুন।
শুভাশীষ ভৌমিক : ওর সাথে কাটানো আমার প্রতিটি মুহূর্তই স্পেশাল। এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগে, যখন আমি ওকে বিভিন্ন সারপ্রাইজ দেই, তখন ওর আনন্দমাখা ও বিস্ময়ভরা চোখ দেখতে।
ওমেন্সকর্নার : আমাদের সমাজে সন্তানদের লালন পালনের দায় - দায়িত্ব মাকেই নিতে হয়। বাবারা খরচ দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করতে চান। এটা কি উচিত ? এই বিষয়ে আপনার মতামত কী ?
শুভাশীষ ভৌমিক : আমি আগেই বলেছি সবার জীবনধারা ও জীবনদর্শন এক হয় না। সবাইকে একই মানদন্ডে বিচার করাও যাবে না কারণ অনেকের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে।
কিন্তু সন্তান যেমন দুজনের তাই দায়িত্বও দুজনের। নিজেদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে দায়িত্ব বন্টন করে নেয়া যেতে পারে। অবশ্যই কাউকে না কাউকে স্যাক্রিফাইস করতেই হবে। আমার মতে যতটুকু সম্ভব সন্তানের সাথে কোয়ালিটি টাইম কাটানো উচিৎ, তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার গুরুত্ব দেয়া উচিৎ, তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকাশে সহায়তা করা উচিৎ।
ওমেন্সকর্নার : আপনি একজন দায়িত্ববান বাবা। একজন দায়িত্ববান বাবা হিসেবে একজন সন্তানের জীবনে মায়ের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলুন।
শুভাশীষ ভৌমিক : বাপকা বেটার এই পথ চলা কখনোই এই পর্যন্ত আসতো না,যদি না ঋতুরাজের মা তার সবটুকু আমাদের জন্য উজাড় করে দিতেন। আমি সবসময়ই বলি আমাদের এই পথযাত্রার প্রধান চাবিকাঠি ঋতুরাজের মা। ঋতুরাজের সবকিছুতেই তার অবদান অনন্য, যা হয়তো প্রকাশ্যে আসে না। কিন্ত পর্দার আড়ালের প্রধান ব্যাক্তি তিনিই।
পাশাপাশি অবশ্যই আমি আমার মা কেও ক্রেডিট দিতে চাই,যেভাবে তিনি আমাদের পুরো পরিবারকে একত্রিত করে রেখেছেন তার ভালোবাসার বন্ধনে, তা সতিই প্রশংসনীয়। আমাদের পুরো পরিবার তাকে ঘিরে আবর্তিত।
তাই আমি মনে করি একজন সন্তানের জীবনে অনেকের ভূমিকা আছে।
আরো পড়ুন : বয়স্ক মানুষদের কমন কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কী সেগুলো ?