` মেয়েদের ভ্রমণ ব্যাপারটা আমরা এখনো খুব ভালোভাবে নিতে পারি না। `
- ফারজানা আক্তার
- আগস্ট ১২, ২০২১
অনলাইন ভিত্তিক ট্রাভেল গ্রুপের তরুণ উদ্যোক্তা রায়হান রিয়াদ। রিয়াদের ট্রাভেল গ্রুপের নাম প্রকৃতিযাত্রী। অনলাইনে বেশ জনপ্রিয় গ্রুপটি। আমাদের দেশে ভ্রমণকে বিনোদন হিসেবে দেখা হয়। এই বিনোদনের পাশাপাশি একে বিজনেসে রূপ দিতে প্রচুর সাহসের প্রয়োজন হয়। রিয়াদ সেই সাহস দেখিয়েছেন। পড়ি তার সেই সাহসিকতার গল্প। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারজানা আক্তার।
ওমেন্সকর্নার : কঠোর লকডাউনে ট্রাভেল বিজনেস কতটা কঠিন হলো ?
রায়হান রিয়াদ : আসলে এক কথায় এর উত্তর দেয়াটা খুব কঠিন। আপনি আগেই বললেন ভ্রমণকে আমাদের দেশ, দেশের প্রশাসন শুধু বিনোদন হিসেবে দেখে। এই ভ্রমণ যে কারও পেশা হতে পারে এটা তারা বেমালুম ভুলে গেছে বৈকি। লক ডাউন কঠোর হোক অথবা সীমিত হোক, পর্যটন বন্ধ থেকেছে সবসময়। এক মুহূর্তের জন্যও পর্যটন শিল্পের কি অবস্থা সেদিকে কারও চোখ ছিল না৷ যাইহোক, সব মিলিয়ে লক ডাউন ও করোনার সময়টা ট্রাভেল বিজনেসের জন্য এক বিভীষিকাময় অবস্থা।
ওমেন্সকর্নার : কোন ভাবনা - চিন্তা থেকে 'প্রকৃতিযাত্রী' - র জন্ম হলো ?
রায়হান রিয়াদ : আমি ঘুরতে পছন্দ করি অনেক আগে থেকে। আসলে শুধু পছন্দ করি বললে ভুল হবে। আমার আসলে ঘুরাঘুরিতে এক অন্যরকম প্যাশন ছিলো। চট্টগ্রাম ভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর মনে হলো এই দশটা পাঁচটা জব আমার জন্য না। আমি মুক্ত বিহঙ্গ হতে চাই। এই ভাবনা থেকেই মূলত প্যাশনকে প্রফেশনে নেয়ার ইচ্ছা জাগে। সঙ্গীর সাহসে জন্ম নেয়া প্রকৃতিযাত্রী।
ওমেন্সকর্নার : ভ্রমণ নিয়ে এই দেশের মানুষদের ভাবনা - চিন্তা কী মনে হয় ?
রায়হান রিয়াদ : ওভারঅল বলতে গেলে নেগেটিভ, তবে দিন দিন নেগেটিভ থেকে পজিটিভ হচ্ছে। এবং এই পজিটিভ হওয়ার গ্রোথ খুবি ভালো। তবে যেই ব্যাপারটা সবচেয়ে নাড়া দেয়া সেটা হলো মেয়েদের ভ্রমণ ব্যাপারটা আমরা এখনো খুব ভালো ভাবে নিতে পারি না। আসলে আমাদের সমাজব্যবস্থাটাই আমাদের মেয়েদের ব্যাপারে এরকম ভাবতে বাধ্য করেছে। ধর্মীয় গোড়ামী ট্রাভেল বিজনেসের জন্য আরেকটি বড় বাঁধা।
আরো পড়ুন : অসম্ভব সুন্দর ভ্রমণ স্থান মালদ্বীপের বারোস আইল্যান্ড
ওমেন্সকর্নার : যতগুলো ট্যুর দিয়েছেন। তার মধ্যে থেকে একটি ভালো এবং একটি খারাপ অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন।
রায়হান রিয়াদ : ট্যুর দিয়েছি অসংখ্য। তবে প্রকৃতিযাত্রীদের নিয়ে ট্যুর দিয়েছি ৮০+ ট্যুর। সবচেয়ে ভালো ও সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়েছিল মনপুরা দ্বীপে ক্যাম্পিং ট্যুরে। আমরা মনপুরায় ক্যাম্পিং করতে গিয়েছি দেখে এলাকায় বেশ সারা পড়ে গিয়েছিল। চেয়ারম্যান তার বাসায় আমাদের দাওয়াত দিয়ে এক বেলা খাবার খাইয়েছিল।
এলাকার মেম্বার নিজে এসে বেশ কয়েকবার খোঁজ নিয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা একদম আশা করি নি। এছাড়া আমরা তাবু, হ্যামক, ব্যাগ পত্র ক্যাম্পে রেখে সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছি৷ একটা জিনিসও এদিক সেদিক হয়নি। অথচ পাশেই লোকালয়। ট্যুরিজম গ্রো হোক, এই জিনিসটা মনপুরার প্রত্যেকটা মানুষ চায়। এবং তারা এ ব্যাপারে খুব সচেতন।
বাজে এক্সপেরিয়েন্স বলতে গেলে প্রথমেই আমাদের ৭ম আমিয়াখুম ট্রিপের কথা মনে পরে। এই ট্রিপে যা যা সেট করা ছিল, তার কিছুই ফুলফিল হয় নি। চান্দের গাড়ি থেকে শুরু করে নৌকা, গাইড সবার অতি লোভী আচরণ বেশ দুঃখ দিয়েছিল সেবার। কোনমতে ট্যুরটা শেষ করেছিলাম। গেস্টরা সবাই সাপোর্টিভ ছিল বলে রক্ষা।
ওমেন্সকর্নার : 'প্রকৃতিযাত্রী' - র শক্ত অবস্থান তৈরি করার জন্য কতটা চ্যালেঞ্জ অনুভব করছেন ?
রায়হান রিয়াদ : প্রকৃতিযাত্রীর আজকের এই অবস্থানের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী আমার সহযোদ্ধা তাসলিমা বাবলী। সেই সাথে ট্রাভেল কমিউনিটির কিছু ভাই ব্রাদার। এরা না থাকলে কখনোই প্রকৃতিযাত্রীর প্রকৃতিযাত্রী হয়ে ওঠা হতো না। তবে শুরু থেকে এখন অবধি অনেকেই বদনজরে পড়েছি। এবং খুব সফলভাবে সেগুলা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সবমিলিয়ে চ্যালেঞ্জটা খুব একটা সহজ নয় অ অবশ্যই।
আরো পড়ুন : ক্রোয়েশিয়ার ট্রোগির বিশ্বে পরিচিতি পর্যটকের ভ্রমণ স্থান
ওমেন্সকর্নার : কেন আমরা 'প্রকৃতিযাত্রী' - র সাথে ট্যুর দিবো ? বিশেষত্ব কী ?
রায়হান রিয়াদ : আমাদের বিশেষত্ব হলো স্বচ্ছতা। আমরা যেটা পারবো, সেটাই বলি। এখানে কোন লুকাচুরির জায়গা নেই। কম খরচে বেস্ট ট্যুর, ৫০০/১০০০ টাকায় এই ট্যুর, সেই ট্যুর, এরকম কোন ট্যুর প্রকৃতিযাত্রী করে না। আমরা প্রাধান্য দেই সার্ভিসে।
ওমেন্সকর্নার : জনগণ কম বাজেটে বেস্ট ট্যুর চায়। এই বিষয়টা কিভাবে হ্যান্ডেল করেন ?
রায়হান রিয়াদ : এটা একটা মেজর প্রব্লেম। মানুষের চাহিদার শেষ নেই। অনেকে আবার বাজেট ট্রিপ আর রিল্যাক্স ট্রিপের পার্থক্য বোঝে না। লো বাজেটে লো সার্ভিস, বেশি বাজেটে ভালো সার্ভিস৷ এই নীতিটাই সত্য। এখন এই ব্যাপারে কে কতটুকু সফল হতে পারে এটাই মূল ব্যাপার।
ওমেন্সকর্নার : অনেক সময় হয় না ভ্রমণ পরিকল্পনা যেভাবে সাজান সেটা ভ্রমণে এলোমেলো হয়ে যায়। হয়তো বাস দেরিতে আসে বা মাঝপথে নষ্ট হয়ে যায়। খাবারে সমস্যা দেখা দেয়। তখন কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন ? সেই মুহূর্তটা কতটা চ্যালেঞ্জিং মনে হয় ?
রায়হান রিয়াদ : আসলে আমরা যারা ট্যুর এরেঞ্জ কর তাদের হাতে সবসময় সবকিছু থাকে না। একটা ট্যুর প্ল্যানের ৭০-৮০% ফুল ফিল হওয়াটাই সার্থকতা। বাকি ২০-৩০% আসলে ভাগ্যের উপর ডিপেন্ডেড। অনেক সময় অনেক গেস্ট এটা বুঝতে চায় না। আবার অনেকে সাপোর্ট দেয়। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। আসলে এরকম একটা মেন্টাল সেটাপ হয়ে গেছে। এরকন পরিস্থিতি আসবেই, এবং মাথা ঠান্ডা রাখাটা তখন সবচেয়ে বেশি দরকার।
আরো পড়ুন : পর্যটকদের পছন্দের আকর্ষনীয় স্থান কানাডার ব্যানফ
ওমেন্সকর্নার : 'প্রকৃতিযাত্রী' নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?
রায়হান রিয়াদ : সত্যি কথা বলতে সেভাবে কোন প্ল্যান নিয়ে কখনো আগাইনি। অনেকটা প্ল্যান ছাড়াই প্রকৃতিযাত্রী এই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে এখন সময় হয়েছে আসলে প্ল্যান করা। প্রকৃতিযাত্রী ছড়িয়ে যাবে দেশের র্যুট লেভেল থেকে আরও র্যুট লেভেলে। পরিপূর্ণ একটা ট্রাভেল প্লাটফর্ম হবে। সবকিছু থাকবে একই প্লাটফর্মে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটে রিসোর্ট আর এসেট বিজনেসে ঢুকেছি। এটা আরও বড় পরিসরে ক্লন্টিনিউ করার ইচ্ছে আছে। আপাতত এই পরিকল্পনা।
ওমেন্সকর্নার : যেহেতু ওমেন্সকর্নারে ইন্টারভিউ দিচ্ছেন। ওমেন্সদের ভ্রমণ নিয়ে আপনার কিছু বলা উচিত। প্রকৃতিযাত্রীর সাথে ভ্রমণে মেয়েরা কতটা নিরাপদ ? মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি কিভাবে হ্যান্ডেল করেন ?
রায়হান রিয়াদ : মেয়েদের ভ্রমণ নিয়ে আগেই বলেছি। আমাদের দেশ মেয়েদের জন্য ট্যুর ফ্রেন্ডলি না একদমই। আমরা এখনো এ ব্যাপারে খুব পিছিয়ে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। এটা একদিনেই হয়ে যাবে এমন না। তবে ধীরে ধীরে নিজেদের ভেতর ধারণ করতে হবে। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বাধ্য।
একটা ব্যাপার গর্বের সাথে বলতে পারি, প্রকৃতিযাত্রীর বেশির ভাগ গেস্ট হয়ে আসে মেয়েরা। এটা শুধু আমার সঙ্গী তাসলিমা বাবলী মেয়ে বলে এমনটা না। এটা একটা বিশ্বাস। প্রকৃতিযাত্রী গ্রুপটা মেয়েদের জন্য সবসময় জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। মেয়েদের সেফটি এনসিওর করেই আমরা ট্যুর এরেঞ্জ করি। ঘুরতে ঘুরতে যেহেতু লোকাল অনেক সাপোর্ট আমাদের ফেভারে চলে এসেছে। তাই আমরা খুব সহজেই মেয়েদের সেফটি ইস্যুটা লোকালি হ্যান্ডেল করতে পারি।
আরো পড়ুন : বেলারুশ সম্পর্কে বিস্তারিত