মহেড়া জমিদার বাড়ির গল্প এবং ভ্রমণ
- ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
- অক্টোবর ২২, ২০১৭
মহেরা পুলিশ একাডেমী শুধু মাত্র একটি পুলিশ একাডেমী নয় ! পুরানো একটা জমিদার বাড়িকে মোটামুটি অপরিবর্তিত রেখে পুলিশ একাডেমী বানানো হয়েছে। এটি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।
বাংলায় মুসলিম শাসনামলে জমিদারি দেয়া হতো সনদের মাধ্যমে এবং এটি প্রথা অনুযায়ী বংশগত ছিল। এরা ভূমির স্থায়ী সত্ত্বাধিকারী না বা মালিক না হয়েও সরকারকে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের মাধ্যমে বংশপরম্পরায় জমিদারি ভোগ-দখল করতেন। খুব বেশি গুরুতর কোন অপরাধ না করলে সাধারণত কোনো জমিদারকে জমিদারি থেকে উচ্ছেদ করা হতো না। এই সময়ে রায়ত বা সাধারণ কৃষক ছিল ভূমির ভোগদখলকারী, জমিদারগণ ছিল রাষ্ট্রের অধীনস্থ ভূমি-রাজস্ব আদায়কারী এবং রাষ্ট্র ছিল ভূমির প্রকৃত মালিক।
এরপর মুসলিম সূর্য অস্তানমিত হলো, শুরু হলো ব্রিটিশ শাসন। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দবস্ত অনুযায়ী জমির মালিকেরা হলো ভূমির আসল মালিক বা স্বত্বাধিকারী, এর ফলে জমিদারের ইচ্ছা মতো তাদের ভূসম্পত্তির সরকারের অনুমোদন ছাড়াই ক্রয়-বিক্রয়, হস্তান্তর বা বন্ধক দেবার অধিকার লাভ করে। এই সময়ে ইংরেজদের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণের ফলে এদেশে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত বহু বড় বড় জমিদারির আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ পতন ঘটে নতুন-নতুন জমিদারির সৃষ্টি হয়। নব্য-সৃষ্ট এসব জমিদারদের অধিকাংশই সরকারী কর্মকর্তা কিংবা ব্যবসায়ী শ্রেণির মধ্য থেকে আগত। মহেড়ার জমিদাররা ছিলেন এই শেষোক্ত শ্রেণির।
টাংগাইল জেলা জমিদারদের জন্য বেশ বিখ্যাত। এই অঞ্চলের বড় জমিদারিগুলোর মধ্যে অন্তত তিনটি মোঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত। এরা হলো -- করটিয়ার পন্নী, সন্তোষ (কাগমারী জমিদার) এবং ধনবাড়ি। এছাড়া এই অঞ্চলে বেশ কিছু ক্ষুদ্র জমিদার শ্রেণির বিকাশ হয়েছিল, যাদের কীর্তির সাক্ষ্য এখন বর্তমান। মহেড়া জমিদারির পত্তন হয়েছিল ১৮৯০ সালে। বিন্দু সাহা, বুদ্দু সাহা, হরেন্দ্র সাহা ও কালীচরণ সাহা নামের চার ভাই এই জমিদারির অংশীদার ছিলেন। হিন্দুদের মধ্যে ‘সাহা’রা হলো ব্যবসায়ী শ্রেণি।
ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, মহেড়ার সাহারা ছিলেন কলকাতার ডালের ব্যবসায়ী । অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এরা মহেড়া এসে বসবাস শুরু করেন এবং স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে দাদন খাটিয়ে বিস্তর টাকা-পয়সা উপার্জন করেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করলে এদের ছেলেরা করটিয়ার ২৪ পরগনার জমিদারদের কাছ থেকে জমিদারির একটি অংশ কিনে নেন। জমিদার বিন্দু সাহা, বুদ্দু সাহা, হরেন্দ্র সাহা এবং কালীচরণ সাহার পরবর্তী বংশধরগণ 'রায় চৌধুরী পদবী’ লাভ করেন। উনবিংশ শতকের চল্লিশের দশকে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি হয়। দেশ বিভাগের পরে এই জমিদার বংশের দু’জন সদস্য ছাড়া বাকি সবাই কলকাতার শোভা বাজার এবং সল্ট লেক এলাকায় পাড়ি জমান।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর মহেড়া জমিদার বাড়িসহ পুরো গ্রামে হামলা চালায়। এক নির্মম গণহত্যা সাক্ষী হয় মহেড়া জমিদার বাড়ি। সেদিন ছিল ১৪ মে, সকাল দশটা—জমিদার বাড়ির ‘চৌধুরী লজের’ সামনের লনে দাঁড় করিয়ে জমিদার বাড়ির কুলবধু যোগমায়া চৌধুরানীসহ আরও পাঁচ জনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী হানাদারেরা। বিধ্বস্ত হয় জমিদার বাড়ি এবং এদের শেষ উত্তরসূরিরাও বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমায় কলকাতায়। বাংলাদেশ দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মান্নান পরিত্যক্ত এই জমিদার বাড়িটিতে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার স্কুল স্থাপন করেন। ১৯৯০ সালে যা ‘পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
প্রায় ১১শ’ ৭৪ শতাংশ জমির উপর অবস্থিত মহেড়া জমিদার বাড়ির চার ভাগে রয়েছে চারটি মূল প্রসাদ, যাদের নাম মহারাজা লজ, আনন্দ লজ, চৌধুরী লজ এবং কালীচরন লজ। বিশাল পুকুরটির পোশাকি নাম হলো বিশাখা সাগর, বর্তমানে এর একপাশে রয়েছে টিকেট কাউন্টার।
প্রাসাদ কমপ্লেক্সে প্রবেশ করার জন্য কালিচরন লজ আর চৌধুরী লজের সামনে রয়েছে দুটি সিংহ দরজা। বর্তমানে যেখানে টিকিট কাউন্টার সেখান দিয়ে ঢুকলে প্রথমে চোখে পড়বে একতলা কালীচরন ভবন, এরপর পর্যায়ক্রমে চৌধুরী লজ, আনন্দ লজ এবং মহারাজা লজ। কালীচরন ভবন ছাড়া বাকি সব গুলো প্রাসাদই দ্বিতল, যাদের সামনের দিকে রয়েছে কোরান্থিয়ান স্তম্ভের সারি। চুন সুরকি আর ইটের সমন্বয়ে তৈরি ভবনগুলোর কার্নিশ, প্যানেলের কারুকাজ চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এদের দোতলায় উঠার সিঁড়ির রেলিং আর বারান্দায় আছে কাস্ট আয়রনের কারুকাজ করা রেলিং। আনন্দ লজ এবং মহারাজা লজের দু’পাশে একতলা কাচারি ভবন আর সামনে বড় লনে ফুলের বাগান।
অলংকরণের দিক থেকে আনন্দ লজটিকে ঐতিহ্যের কাছে সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়। প্রাসাদের সম্মুখভাগে দোতলা পর্যন্ত লম্বা ছয়টি কোরান্থিয় স্তম্ভ, সামনের দিকে দুপাশে কারুকাজ করা দুটি ভ্যানিসিয় ঝুল বারান্দা, ছাদের রেলিং এবং কার্নিশে ফুলের মালা, পাখি আর জ্যামিতিক অলংকরণ প্রাসাদটিতে আলাদা সৌন্দর্য্য যোগ করেছে। ওদিকে মহারাজা লজের ছাদের চূড়ায় রয়েছে ফুল,লতা-পাতায় অলংকৃত অপূর্ব সুন্দর একটা ত্রিকোনাকার পেডিমেন্ট। এছাড়া এই প্রাসাদের সামনের দিকে ছয়টি কোরান্থিয়ান ধাঁচের স্তম্ভ এবং প্রতিটি জানালার উপরে ত্রিফয়েল আর্চের ব্যবহার একটি চম ৎ কার ফিউশনের সৃষ্টি করেছে ।
দু’পাশের বারান্দার উপরে রয়েছে প্যাঁচানো ধাঁচের লেগো , এটাকে মনে করা হয় মহেড়া জমিদারির সিল ! মহারাজা লজের পেছনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গার পরে একতলা আরেকটি ভবন। ভবনটির সামনের দিকে অনুচ্চ স্তম্ভের উপরে নির্মিত ত্রিফয়েল আর্চ যুক্ত প্রবেশদ্বার আছে। এর পেছনের অংশে অলংকৃত কাঠের দরজা, যাকে আধুনিক কালের সংযোজন বলে মনে হয়েছে। মহারাজা লজ এবং এই ভবনের মাঝখানের জায়গাটায় পুলিশ প্রশাসন সিমেন্ট বালু দিয়ে তৈরি বাঘ, হরিণ, সারস, ঘোড়া, দোয়েল ইত্যাদি দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু সমান আকারের ঘোড়া এবং দোয়েল, বিশাল হরিণ, বিড়ালের মতো বাঘ পুরো বিষয়টাকে কেমন যেন হাস্যকর করে তুলেছে।
যাই হোক এর পাশে একটি রাস্তা তারপর কালীচরণ ভবন, যেটি একতলা। ভবনের সামনের দিকের উন্মুক্ত কক্ষে দুই সারি অনুচ্চ স্তম্ভের উপরে নির্মিত ত্রিফয়েল আর্চের সারি এবং দেয়ালে তিনটি বড় কুলঙ্গি। ভবনের চূড়ায় ত্রিকোণাকার পেডিমেন্টে পদ্ম, শঙ্খ, গদা, চক্র ও ‘ওম’ চিহ্ন থেকে বুঝা যায় এটা মন্দির ছিলো আগে। এই ভবনের সামনে বড় একটা ঘাসে ছাওয়া লন আর একপাশে ‘নায়েব ভবন’ নামের এক তলা স্থাপনা।
এসব স্থাপনা ছাড়াও এই জমিদারি কমপ্লেক্সের পেছনের দিকে রানী মহল, কর্মচারীদের থাকার জন্য কিছু ভবন এবং দুটি পুকুর । পুলিশ প্রশাসন বেশ রং-টং করে সব রঙ্গিন করে রেখেছেন।
কিভাবে যাবেন : টাঙ্গাইলের জমিদার বাড়ি দেখতে হলে খুব সকালে বাসা থেকে বের হতে হবে। কারণ যেতে আপনার প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা লাগবে। মহাখালি থেকে “ঝটিকা সার্ভিস” নামে বাস ছাড়ে। এছাড়া টাঙ্গাইল যাওয়ার আরো বেশ কিছু ভাল বাস রয়েছে । মহেরা জমিদার বাড়ির বর্তমান নাম মহেরা পুলিশ ট্রেইনিং সেন্টার। ওখানে যেতে হলে আপনাকে নামতে হবে”নাটিয়া পাড়া” বাস স্ট্যান্ড । সময় লাগবে ২-২.৩০ ঘন্টার মত। বাস থেকে নেমে আপনাকে একটা অটো রিকশা নিতে হবে। রিক্সায় করে সরাসরি মহেরা জমিদার বাড়িতে যাওয়া যাবে। ভাড়া ২০-৩০ টাকা। জমিদার বাড়ি ঢুকতে টিকেট কিনতে হবে, জন প্রতি ২০টাকা।