স্মার্টফোন ক্যামেরা প্রযুক্তি ঠিক কোন পথে হাঁটছে?
- ওমেন্সকর্নার ডেস্ক
- মে ১৩, ২০১৮
চলছে স্মার্টফোন বিপ্লব, আসছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি। বাজেটবান্ধব স্মার্টফোন থেকে শুরু করে দামি ফ্লাগশিপ সকল স্মার্টফোনেই ডুয়াল ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়টি এখন এক নতুন ট্রেন্ড। স্মার্টফোনগুলোতে ছবি তোলার জন্য একসময় একটিমাত্র ক্যামেরা ব্যবহৃত হলেও সাম্প্রতিক অনেক স্মার্টফোনে ব্যবহৃত ডুয়াল ক্যামেরা ব্যবস্থাপনা উন্নততর অপটিক্যাল জুম ব্যবস্থা, পোট্রেট মোড এবং আরো আকর্ষণীয় ছবির ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে বাজারে দুটি রিয়ার ক্যামেরার যত স্মার্টফোন পাওয়া যায়, সেগুলোর প্রধান ক্যামেরা বাদে দ্বিতীয় সাহায্যকারী ক্যামেরায় ব্যবহৃত লেন্সগুলো বিশ্লেষণ করলে মোটামুটিভাবে চার ধরনের লেন্সের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এগুলো হচ্ছে-
- ডেপথ সেন্সর ক্যামেরা
- মনোক্রোম সেন্সর ক্যামেরা
- ওয়াইড এঙ্গেল ক্যামেরা
- টেলিফটো ক্যামেরা
ডেপথ সেন্সর ক্যামেরা : মধ্য বাজেটের অধিকাংশ ডুয়াল ক্যামেরার স্মার্টফোনে সাহায্যকারী দ্বিতীয় ক্যামেরা হিসেবে সাধারণত ডেপথ সেন্সর ক্যামেরা ব্যবহৃত হচ্ছে। সহজ ভাষায়, ছবির পারিপার্শ্বিকতা বোঝার জন্য যে বিশেষ ক্যামেরা সেন্সর ব্যবহৃত হয় তাকে ডেপথ সেন্সর বলে। বর্তমানে ছবির ক্ষেত্রে পোট্রেট মোড বেশ জনপ্রিয়। পোট্রেট মোডে ছবির বিষয়বস্তু এবং পেছনের পটভূমির মধ্যে একটি দৃশ্যগত পার্থক্য দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ- ধরা যাক, একটি ফুলের বাগানে আপনার ছবি তোলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পোট্রেট মোডে ছবি তোলা হলে আপনার পেছনের ফুলগুলো আপনার তুলনায় অনেকটা ঝাপসা বা ব্লার থাকবে। এক্ষেত্রে মূলত ছবির বিষয়বস্তু এবং চারপাশের পটভূমি সম্পর্কে একটি সামগ্রিক থ্রিডি ধারণা নেয়ার জন্য দুটি সেন্সর ব্যবহৃত হয়। প্রধান সেন্সরটি মূল বিষয়বস্তুর ছবি তোলে এবং দ্বিতীয় সেন্সরটি পটভূমির সাথে বিষয়বস্তুর দূরত্ব সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা গ্রহণের চেষ্টা করে। পরবর্তীতে দুটি সেন্সরে পাওয়া তথ্যগুলো একীভূত হয়ে একটি ছবি তৈরি হয়।
মনোক্রোম সেন্সর ক্যামেরা : মটোরোলার ফ্লাগশিপ স্মার্টফোনগুলোতে এ ধরনের সেন্সরের ব্যবহার প্রথম দেখা গিয়েছিল। এরকম ক্যামেরা ব্যবস্থাপনায় প্রধান সেন্সর হিসেবে একটি আরজিবি (RGB) সেন্সর থাকে। অপর সেন্সরটি সাধারণত একই মেগাপিক্সেল ও অ্যাপাচারের মনোক্রোম হয়ে থাকে। মনোক্রোম সেন্সরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে শুধুমাত্র সাদা এবং কালো রঙ বাদে অন্য রঙের জন্য কোনো সেন্সর ফিল্টার থাকে না। এক্ষেত্রে ছবির তোলার পরে সাধারণত দুটি ছবি আসে। একটি রঙ্গিন ছবি এবং অন্যটি সাদা-কালো। পরবর্তীতে ব্যবহারকারী চাইলেই দুটি ছবির সমন্বয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো মানের ছবি তৈরি করে নিতে পারেন। মনোক্রোম সেন্সরটি ডেপথ সেন্সিংয়ের জন্য ব্যবহার করেও বেশ ভালো মানের পোট্রেট মোড ছবি পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি ঠিক আগের মতোই। দেখা যাচ্ছে, মনোক্রোম সেন্সর দিয়ে দুই ধরনের কাজ করা যাচ্ছে। সাদা-কালো ছবির পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত ভালো মানের আরজিবি ছবি এবং সাথে চাইলে পোট্রেট মোডেও ছবি পাওয়া যাচ্ছে। হুয়াওয়ের সাম্প্রতিক ফ্লাগশিপ ফোনগুলোতে মনোক্রোম সেন্সর ব্যবহৃত হচ্ছে।
ওয়াইড এঙ্গেল ক্যামেরা : স্মার্টফোন ক্যামেরার সাথেই যদি একশন ক্যামেরার কাজটি হয়ে যায়, তবে বিষয়টি বেশ দারুণ হয়। এলজি জি-ফাইভ দিয়ে স্মার্টফোন বাজারে ওয়াইড এঙ্গেল ক্যামেরার যাত্রা শুরু হলেও সময়ের সাথে সাথে এর পরিসর বেড়েছে। এ ধরনের ক্যামেরা ব্যবস্থাপনায় প্রধান ক্যামেরা সেন্সরটির পাশাপাশি বাড়তি এঙ্গেলের লেন্স ব্যবহৃত হয়। সাধারণ লেন্সটির তুলনায় এই লেন্সটির ফিল্ড ভিউ বেশি থাকে। ফলে ছবি তোলার ক্ষেত্রে আরো আকর্ষণীয় এবং প্রশস্ত ছবি পাওয়া যায়। ছবিগুলো দেখতে মনে হয় যেন আলাদা কোনো একশন ক্যামেরায় তোলা।
এলজি জি-ফাইভ দিয়ে স্মার্টফোন ক্যামেরায় এ ধরনের লেন্সের যাত্রা সূচিত হলেও এলজি জি সিক্স, ভি থার্টি এবং সম্প্রতি ঘোষিত হওয়া জি সেভেনে ওয়াইড এঙ্গেল ক্যামেরা সেন্সরে ক্রম-অগ্রগতি এসেছে। প্রথম পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত কম মেগাপিক্সেলের সেন্সর ব্যবহৃত হলেও এখন এ ধরনের ক্যামেরা ব্যবস্থাপনায় বেশ ভালো মানের সেন্সর ব্যবহৃত হচ্ছে। এলজির ফ্লাগশিপ স্মার্টফোনগুলো এ ধরনের ক্যামেরার জন্য প্রসিদ্ধ হলেও বাজারে মটোরোলার মটো এক্স-ফোর এবং অ্যাসুসের জেনফোন ফোর-এ এ ধরনের ওয়াইড এঙ্গেল ক্যামেরা দেখা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে ২য় সেন্সরটি কোনো সাহায্যকারী সেন্সর হিসেবে কাজ করে না, বরং প্রধান সেন্সরের পাশাপাশি সম্পূর্ণ স্বাধীন ক্যামেরা সেন্সর হিসেবে কাজ করে।
টেলিফটো ক্যামেরা : আইফোনের নতুন সকল সংস্করণ, স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট এইট, এস এইট প্লাস, এস নাইন প্লাস সহ সাম্প্রতিক সময়ের অধিকাংশ ফ্লাগশিপ স্মার্টফোনে টেলিফটো ক্যামেরার ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। স্মার্টফোনগুলোর প্রধান ক্যামেরা সেন্সরে সাধারণত ডিজিটাল জুমের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু টেলিফটো লেন্স হচ্ছে এমন একটি ক্যামেরা ব্যবস্থা যেখানে বাড়তি একটি লেন্সের মাধ্যমে দ্বিগুণ অপটিক্যাল জুম পাওয়া যায়। ফলশ্রুতিতে, এ ধরনের ক্যামেরা ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানের ডিজিটাল জুমের বদলে ডিজিটাল ক্যামেরাগুলোর মতোই একটি বেশ কার্যকরী জুমের ব্যবস্থা থাকে।
শুধু দ্বিগুণ অপটিক্যাল জুম নয়, টেলিফটো লেন্স পোট্রেট মোডে ছবির জন্যও সবচেয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা। মধ্য বাজেটের ফোনগুলোতে ব্যবহৃত ডেপথ সেন্সর ক্যামেরাগুলোর তুলনায় টেলিফটো ক্যামেরায় অনেক ভালো মানের ব্লার ইফেক্টযুক্ত পোট্রেট ছবি পাওয়া সম্ভব। ডেপথ সেন্সরে সাধারণত ছবির প্রান্তগুলোতে কিছু না কিছু ত্রুটি থেকে যায়। কিন্তু টেলিফটো ক্যামেরায় অনেক ভালো এজ পাওয়া সম্ভব। ঠিক এ কারণেই দামি সব ফ্লাগশিপ স্মার্টফোনেই প্রধান ক্যামেরা সেন্সরের পাশাপাশি টেলিফটো ক্যামেরা সেন্সরের ব্যবহার আজ একটি নিয়মিত বিষয়। টেলিফটো ক্যামেরার আরো একটি চমৎকার ফিচার রয়েছে। মটো এক্স ফোর, জেনফোন থ্রি জুম, শাওমি এ ওয়ান ইত্যাদির মতো সাম্প্রতিক বেশ কিছু স্মার্টফোনের টেলিফটো ক্যামেরায় কিছুটা ওয়াইড এঙ্গেলেও ছবি পাওয়া যায়। যদিও নির্দিষ্ট ওয়াইড এঙ্গেল সেন্সরের মতো এটি এতটা কার্যকরী নয়, তবুও কিছুটা ওয়াইড এঙ্গেলে ছবি পাওয়া বেশ সুখকর একটি ফিচার।
গুগল পিক্সেল বিস্ময় : বিভিন্ন স্মার্টফোন কোম্পানি যখন তাদের R&D ল্যাবে ডুয়াল ক্যামেরার উন্নতিকল্পে কোটি কোটি টাকা খরচ করে চলেছে, তখন গুগল একটু ভিন্ন পথে হাঁটছে। মজার বিষয় হচ্ছে, অনেক কোম্পানি পোট্রেট মোডের ছবির জন্য টেলিফটো অথবা ডেপথ সেন্সরের উপর নির্ভরশীল হলেও গুগল তাদের পিক্সেল স্মার্টফোন সিরিজে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র একটি সেন্সর ব্যবহার করেই অন্যদের থেকে দৌড়ে এগিয়ে আছে। আসলে এক্ষেত্রে গুগলের নিজস্ব অপটিমাইজেশনই তাদেরকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। ঠিকমতো অপটিমাইজেশন করা হলে শুধুমাত্র একটি ক্যামেরা সেন্সর দিয়েই যথেষ্ট কার্যকরী পোট্রেট পাওয়া সম্ভব, গুগল পিক্সেল স্মার্টফোনগুলো তার প্রমাণ।
স্মার্টফোন ক্যামেরার ভবিষ্যৎ : স্মার্টফোন ক্যামেরার ক্ষেত্রে এখনো যথেষ্ট অগ্রগতির সুযোগ রয়েছে। বিগত প্রায় দুই বছর ধরে প্রতিটি মোবাইল ফোন কোম্পানি ক্যামেরা সেটআপের উন্নতিকল্পে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। বিগত দুই বছরে চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি সাধিত হলেও দ্বিতীয় লেন্সটির মান এখনো প্রধান সেন্সরটির কাছাকাছি পৌঁছায়নি। এছাড়া, বাজারে টেলিফটো লেন্সযুক্ত একটি ভালো স্মার্টফোনের দামও এখন পর্যন্ত সবার হাতের নাগালে নয়। গবেষণা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে আশা করাই যায় যে নিকট ভবিষ্যতে বেশ বড় রকমের পরিবর্তন আসবে। ডুয়াল ক্যামেরা প্রযুক্তির উন্নতিসহ স্মার্টফোনে তিনটি, এমনকি চারটি ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়টি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আরও সম্প্রসারিত হবে।
সম্প্রতি হুয়াওয়ের ফ্লাগশিপ স্মার্টফোন পি টুয়েন্টি প্রো-এর রিয়ার ক্যামেরা বিভাগে সাফল্যের সাথে তিনটি সেন্সর ব্যবহার করে ছবির মানের ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটি চমক লক্ষ্য করা যায়। অদূর ভবিষ্যতে ছবির মান, আরো কার্যকরী জুম ব্যবস্থা, কার্যকরী পোট্রেট মোডসহ ওয়াইড এঙ্গেল ছবির ক্ষেত্রে নতুন নতুন চমক আসতে চলেছে। পরিশেষে, সবার হাতে হাতে বাজেটবান্ধব কাঙ্ক্ষিত মানের ক্যামেরা স্মার্টফোনগুলো পৌঁছে যাক- এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।
সূত্র : roar